ভৌগলিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানটা এমন একটা জায়গায় যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র সকলেই দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চায়। ইতিহাস বলে তারা একে অপরের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত, কিন্তু তাদের নিজেদের পছন্দের দলকে ক্ষমতায় আনতে কূটনৈতিকভাবে বেশ তৎপর। বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে প্রতিবার তাদের মধ্যে বনিবনা হলেও দশম সংসদ নির্বাচনে কিছুতেই তাদের মধ্যে সমঝোতা হচ্ছে না। তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন ২০০৫ সালের মতো এবারো একটি কূটনৈতিক গ্রুপের মাধ্যমে সমঝোতা হতে পারে বাংলাদেশে। এবার সেই গ্রুপের নাম ফ্রেন্ডসগ্রুপ।
গত মে’র শুরুতে গঠন করা এই গ্রুপে আছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা, ব্রিটিশহাইকমিশনার গিবসন, ইইউ প্রতিনিধি দলের প্রধান ইউলিয়াম হানা, জার্মানিররাষ্ট্রদূত আলব্রেখট কনজে, কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন, জাপানেররাষ্ট্রদূত শিরোশিমা, ইতালির রাষ্ট্রদূত গিয়োর্জিয়ো গুগলিয়েলমিনো, স্পেনের রাষ্ট্রদূত লুইস তেজাদা চেকন, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত এনেলি লিন্ডাকেনি, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত রাগনে বার্থ লান্ড, নেদারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতজারবেন জং, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মিখাইল ট্রিনিকুইর ও অস্ট্রেলিয়ারহাইকমিশনার গ্রেগ উইলকক। প্রভাবশালীদের মধ্যে এই গ্রুপে নেই শুধু চীনেররাষ্ট্রদূত লি জুন ও ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ফের কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা গেছে। বিশ্বের দুই প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূতরা বিরোধী দল এবং সরকারি দলের নেতাদের সাথে বৈঠক করছেন। সর্বশেষ ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাত করেছেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনার গিবসন বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গেও। এর আগে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার তারানকো ঢাকায় এসে একটি সমঝোতার জন্য দুই দলের মহাসচিবকে সামনাসামনি একটি বৈঠকে বসিয়েছিলেন। দুই নেত্রীকে ফোন করেছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকরা মনে করছেন, ২০০৫ সালের টুয়েসডে গ্রুপ এবং ২০০৭ সালের কফি গ্রুপের মতো এবার নির্বাচন নিয়ে সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে ঢাকার ১৩ প্রভাবশালী কূটনীতিকের ফ্রেন্ডস গ্রুপ। সবকিছু মিলিয়ে ফ্রেন্ডস গ্রুপের হাতেই সমাধান হতে পারে।
সংকট সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতা নিয়ে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম বীরপ্রতীক পরিবর্তনকে বলেন, “বাংলাদেশে বর্তমান অসহনীয় বিপদজনক ও সর্বনাশের সম্ভাবনায় ভরপুর। পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ ঘটানোর জন্য ঘরের ভেতরে অথবা বাইরে সকল শুভাকাঙ্খির সকল পদক্ষেপই স্বাগতম। অতএব ফ্রেন্ডস গ্রুপের উদ্যোগ বা তৎপরতা অবশ্যই স্বাগতম। আমি ১৯৭১ সালের রনাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রকাশ্যেই জাতীয়তাবাদী চেতনা লালন করি ও অন্যকে করতে দাওয়াত দেই। এতদসত্বেও আমি বিদেশি শুভাকাঙ্খি বিদেশি বন্ধুদের তৎপরতাকে স্বাগত জানাই। কারণ আমার মূল্যায়নে আমার দেশকে নিয়ে অন্যকিছু বিদেশি বন্ধুর বা রাষ্ট্রের অশুভ তৎপরতা বিদ্যমান। ঘরের এবং বাইরের উভয় চেষ্টার সম্মিলিত ফলশ্রুতিতে সমসা থেকে উত্তোরণ হতেও পারে বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে সমন্বয় প্রয়োজন। এই ফ্রেন্ডসগ্রুপ ইতিবাচক ভুমিকা রাখতে পারে।”
ফ্রেন্ডসগ্রুপ রাজনৈতিক সমস্য সমাধানে কোন প্রভাব ফেলবে কীনা এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি পরিবর্তনকে বলেন, ”এরমধ্যেই বেশ কয়েকদফা বৈঠক করেও কিন্তু কোন সমাধান হয়নি। আর ফ্রেন্ডসগ্রুপ হলো ইন্দো-মার্কিন ধাঁচের একটি গ্রুপ। অন্যদিকে সরকার শুরু থেকেই ভারত এবং রাশিয়ার সাথে একটা সুসম্পর্ক বজায় রেখে আসছে। আওয়ামী লীগকে তারা বেশ ভালো সাপোর্টও দেয়। কাজেই ইন্দো-মার্কিন এই গ্রুপটিকে তেমন আমলে নেবে না সরকার।”
সংকট সমাধানের সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, “বর্তমানে সরকারের সকল সূচকগুলো যেমন, প্রশাসন, আন্দোলনের মাঠ তাদের দখলে। তারা যেভাবে চাচ্ছে সেভাবেই সব হচ্ছে। যদিও সরকারের ফিরে আসার সুযোগ আছে কিন্তু তারা আসছে না। বিএনপি আন্দোলন করে সুবিধা আদায় করতে পারছে না। নির্বাচনটাও হয়তো সরকারের ইচ্ছায় যাবে। তবে দেশে-বিদেশে সেটা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। সেক্ষেত্রে যদি ইন্দো-মার্কিন কূটনৈতিক অবরোধ আসে তাহলে হয়তোবা আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক পরিবর্তনকে বলেন, “সরকারের নির্বাচনের আগে ফিরে আসার সুযোগ নেই। নির্বাচন একটা হবেই। নির্বাচনের পর ফ্রেন্ডসগ্রুপ প্রভাব ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে সমাধান আশাকরা যায়।”
এদিকে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের পর নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে সুনির্দিষ্ট রিপোর্ট পেয়েছে ভারতের নয়াদিল্লি। দেশটিরকেন্দ্রীয় সরকারের সচিবালয় সাউথ ব্লক এ রিপোর্ট দেয়। যে রিপোর্টটি সম্প্রতি সাউথ ব্লকে পৌঁছেছে, তাতে বলা হচ্ছে, ‘এই নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে তার সঙ্গে চূড়ান্ত অসহযোগিতার পথে হাঁটবে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।’
রিপোর্টটিতে বলা হয়, চলমান রাজনৈতিক সংকট বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপরে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। কোনও কারণে এই সরকার পড়ে গিয়ে যদি জামাত সমর্থিত বিএনপি সরকার আসে, তাহলে বিপুল সংখ্যক অনুপ্রবেশকারী মোকাবিলার জন্য ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তখন শুধুমাত্র হিন্দুরাই নন, অসংখ্য ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমানও বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হবেন। আর তাঁদের সহজ গন্তব্য হবে ভারত।
চলতি পরিস্থিতির মোকাবিলায় হাসিনা সরকারকে জরুরি অবস্থা জারি করতে হতে পারে, এমন কথাই বলছে ওই রিপোর্ট।
আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে সে দেশের সংবিধান অনুসারে ৪ মাস পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে সরকার। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮দলীয় জোটবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর দুইদিন।
এই গ্রুপের প্রথম দুই বৈঠকে ভারতের হাইকমিশনার ও চীনের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিক কৌশলগত কারণে তারা গ্রুপে যোগ দেননি। গ্রুপের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন ও জার্মানের রাষ্ট্রদূত আলব্রেখট কনজে। অনেকের ধারণা, চীন-ভারতের দুই কূটনীতিক এ গ্রুপে শামিল হলেই সংকট পানির মতো সমাধান হয়ে যাবে।