বাংলাদেশ ইস্যুতে নীরব মধ্যপ্রাচ্য

0
117
Print Friendly, PDF & Email

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটসহ সার্বিক ইস্যুতে পশ্চিমা ও ইউরোপের কূটনীতিকরা দূতিয়ালিতে সরব থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিকরা এক প্রকার নীরব রয়েছেন। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ আরো কয়েকটি শীর্ষ দেশের অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ থাকায় এ নীরবতা বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের তরফ থেকে এ নীরবতাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হচ্ছে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে মন্তব্য করলে হয়তো ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে এমন ভেবে তারা চুপ আছেন। এছাড়া বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের উল্লেখযোগ্য প্রাধান্য না থাকায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলো অভিমানেও চুপ থাকতে পারে। সূত্র জানায়, গেল বছরের শুরুতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরে নির্বাচনী সরকার নিয়ে প্রধান দুই জোটের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। বিরোধী পক্ষ আন্দোলনে রাজপথে নামে আর সরকার পক্ষ আন্দোলন দমনে সচেষ্ট হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের কূটনীতিকরা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপে বসার বিষয়ে নিজেদের পারস্পরিক বৈঠক এবং রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ অব্যাহত রাখেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার একে একে রায় ঘোষিত হলে জামায়াত-শিবির রাজপথে নেমে আসে। সে সময় সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করতে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি দুটি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করলেও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের শীর্ষ কূটনীতিক এতে অংশ নেননি। কর্মকর্তারা আরো বলেন, ২০১২ সালের ৬ মার্চ ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলী হত্যাকাণ্ডের পর বিষয়টি নিয়ে সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েনের আশঙ্কা করা হয়। তবে এ প্রেক্ষিতে ঢাকাস্থ সৌদি রাষ্ট্রদূত আল বুশাইরি গণমাধ্যমকে পরিষ্কার করে বলেছিলেন, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে সরকার বা তদন্ত সংস্থার প্রতি সৌদি সরকারের পুরোপুরি আস্থা আছে।
জানা গেছে, ওই বছরের আগস্ট মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত ‘সমতার’ বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসা দেয়া বন্ধ করে দেয়। এছাড়া গত বছর সৌদি আরবও শ্রমিক রফতানি কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি সে দেশে থাকা লাখ লাখ বাংলাদেশির আকামা পরিবর্তনের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে।
কূটনৈতিক সূত্র থেকে তখন দাবি করা হয়েছিল, সরকারের পূর্ব ও পশ্চিমমুখী পররাষ্ট্রনীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্য সরকারকে অসহযোগিতা করবে। ফলে সরকারও বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যোগাযোগ আরো বাড়ায়। এ লক্ষ্যে সৌদি আরবকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়ে দেশটির মজলিশে শূরার স্পিকারকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করা হয়। তার এ সফরে দেশটিতে আরো বেশি করে শ্রমিক রফতানির প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়। এরই অংশ হিসেবে পরবর্তীসময়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি দুই দফা রিয়াদ সফর করেন। পাশাপাশি প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনও কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ইস্যুতে তুরস্ক প্রকাশ্যে চলে আসার পাশাপাশি অন্য মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে লবিং শুরু করলে সরকার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আরেক দফা যোগাযোগ বাড়ায়।
পরে দেশের নির্বাচন নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক জোট পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিলে শুরু হয় বিদেশিদের এক ধরনের দৌড়ঝাঁপ। এর মধ্যে নভেম্বরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওমরা করতে সৌদি আরব যান এবং সেখানে তিনি শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, গত মাসে রাজনৈতিক সংকট বাড়লে পশ্চিমা এবং ইউরোপের কূটনীতিকরা অতিমাত্রায় দূতিয়ালি শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কূটনীতিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। এক পর্যায়ে সংকট সমাধানে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে ঢাকায় পাঠানো হয়। তিনি ঢাকা ছাড়ার পরও অন্য দেশের কূটনীতিকদের দূতিয়ালি চলতে থাকে।
সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ঢাকা অভিযাত্রা ঘোষণা এবং পরে অবরোধের ডাক দিলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা এবং যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে বৈঠক করেন। পাশাপাশি গিবসন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গেও বৈঠকে বসেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা মনে করেছিলাম যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কূটনীতিকরা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। কিন্তু তা হয়নি। তবে কিছুদিন আগে ঢাকার কাতারের রাষ্ট্রদূত একবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
তিনি বলেন, যেভাবে বলা হয়েছিল বর্তমান সরকারকে বিভিন্নভাবে মধ্যপ্রাচ্য চাপে রাখবে তা হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। কারণ এ সরকার ভিন্ন কৌশলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। আর তারই প্রমাণ সৌদিতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ শ্রমিককে বৈধ করে নেয়ার বিষয়টি।
কেন মধ্যপ্রাচ্য নীরব এমন প্রশ্নে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সুনির্দিষ্ট খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আলোচনা এগিয়ে নিলেও চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে তারা চুপ রয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার শর্তে তারা বিনিয়োগ করবে এমন ধারণায় বসে থাকায় সংশ্লিষ্টরা কৌশলের অংশ হিসেবে নীরব রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, বন্দর, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, অবকাঠামো ও পর্যটনসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বছর দেড়েক ধরে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে বাহরাইন, ওমান, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এসব খাতে সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা (এক হাজার কোটি ডলার) বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। ফলে তারা চাইবে না কোনো ধরনের মন্তব্য বা দৌড়ঝাঁপের ফলে সরকারের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নষ্ট হোক।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও দুই হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে কাতার। সব মিলিয়ে কাতারের এ দেশে ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া দেশটি বাংলাদেশ ব্যাংকে ১৮০ কোটি ডলার রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে দেশটির পক্ষে নীরবতা পালন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
তিনি বলেন, ঢাকা ও দোহায় কয়েক দফা আলোচনার পর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ মুহূর্তে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছে কাতার। তাছাড়া গত বছরের মার্চে কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে কাতারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে জানানো হয়েছিল, বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তারা বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীল পরিবেশ দেখতে আগ্রহী। ফলে এ মুহূর্ত্বে এসে তারা আর মন্তব্য করতে চাইছে না।
অন্যদিকে সৌদি যুবরাজ আল ওয়ালেদ বিন তালাল বাংলাদেশের জ্বালানি ও পর্যটন খাতে প্রায় ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নে তিনি আগ্রহী নন। ফলে বাধ্য হয়েই এখন সৌদি আরবকে নীরব থাকতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকার সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর সমান সম্পর্ক হয় না। তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতিও ভিন্ন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই। কারণ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রাধান্য পায় রাজনৈতিক কারণে, আর ইউরোপের সঙ্গে পোশাক রফতানি আর মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বিনিয়োগ ও জনশক্তি নিয়ে। ফলে সবার সঙ্গে সমান সম্পর্ক রক্ষা করা সব সরকারের পক্ষেই কঠিন। আর বিষয়টি বিবেচনা করে হয়তো মধ্যপ্রাচ্য রাজনৈতিক সংকট নিয়ে মন্তব্য করে নিজেদের জড়াতে চাইছে না। কারণ তারা বাণিজ্য এবং বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং সরকারকে বুঝানোর চেষ্টা করছে তারা সাতেও নেই পাঁচেও নেই।

শেয়ার করুন