খেলা ছেড়ে দেওয়া সব খেলোয়াড়ের জন্যই কষ্টদায়ক অনুভূতি। দীর্ঘ ও সংগ্রামী ক্যারিয়ার ছিল জাভেদ ওমরের। সবাইকেই থামতে হয়। তাঁকেও থামতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে আবেগ ছুঁয়ে যাচ্ছে জাভেদকেও। আজ তাঁর সম্মানে আয়োজিত বিদায়ী প্রীতি ম্যাচের একপর্যায়ে কান্না লুকোতে পারেননি। আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেওয়া জাভেদ বিদায়বেলার অনুভূতি, স্মরণীয় মুহূর্ত, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি জানাচ্ছেন ‘প্রথম আলো’র পাঠকদের। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন রানা আব্বাস।
বিদায়লগ্নে যাঁদের মনে পড়ছে
বাবা-মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এ বিদায় মুহূর্তে তাঁরা থাকলে অনেক ভালো লাগত। কোচ মন্টু ভাই, আসিফ ভাই (মারা গেছেন); যাঁদের জন্য এত দূর আসা, তাঁরা সবাই থাকলে ভীষণ ভালো লাগত। ছোটবেলায় আসিফ ভাই ক্রিকেট ক্যাম্পে নিয়ে যেতেন। ওর কথা খুব মনে পড়ছে আজ।
শুরুটা যেভাবে
আমাদের ক্রীড়া পরিবার। ভাইয়েরা সবাই ক্রিকেট, হকি, ফুটবল খেলত। আমি সবই খেলতাম! সেবার ইংল্যান্ড সফরের জন্য ১৬০ জন নিয়ে একটা ক্যাম্প করা হলো। সেখানেই অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ মিলল। সুজন ভাই তখন অধিনায়ক ছিলেন। ইংল্যান্ড ট্যুরের পর এশিয়া কাপ ছিল। তখন বুলবুল ভাই, সেলিম ভাই, সুজন ভাই জাতীয় দলে ছিলেন। এশিয়া কাপে ভালো করার পর পুরো মনোযোগ ক্রিকেটেই ঢেলে দিলাম। স্কুল ক্রিকেট খেলেছি। তবে স্কুলে পড়ার সময়ই প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা
প্রথম একদিনের ম্যাচে অভিষেক ১৯৯৫ সালে, ভারতের বিপক্ষে। ১৮ রান করে রানআউট হয়েছিলাম। তখন আসলে ঘোরের ভেতর ছিলাম। বল কোথায় পড়ছে, কোথায় আসছে—কিচ্ছু ঠাওর করতে পারছিলাম না! শ্রীনাথকে খেলছি, কাছেই ফিল্ডিং করছেন শচীন টেন্ডুলকার, আজহারউদ্দিন। এত বড় খেলোয়াড়ের বিপক্ষে খেলছি ভাবতেই গা শিউরে উঠত! পুরোই ঘোরের মধ্যে ছিলাম!
স্মরণীয় ইনিংস
২০০১ সালে বুলাওয়াতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬২, পরের ইনিংসে অপরাজিত ৮৫ করে রেকর্ড বইয়ে জায়গা করে নিলেও আমার কাছে স্মরণীয় ইনিংস ২০০৫ সালে জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২৫৮ বল খেলা ৪৩ রানের সেই ইনিংসটি। ওই ম্যাচটি ড্র করা খুবই জরুরি ছিল। কারণ আগের ম্যাচে চট্টগ্রামে সেই ঐতিহাসিক জয় পেয়েছিলাম (বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়)। ফলে ওই ম্যাচ ড্র করতে না পারলে সিরিজই ড্র হয়ে যেত। নাফিস দুর্দান্ত সেঞ্চুরি (১২১) করল। আমি দীর্ঘ সময় উইকেটে পড়ে থাকলাম। ওই সময় রান তোলার চেয়ে উইকেটে টিকে থাকাই জরুরি ছিল। হ্যাঁ, এটা ঠিক, পেশওয়ারে পাকিস্তানের বিপক্ষে শতক, ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডে ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ হওয়া খুবই স্মরণীয়। তবে সবার থেকে এগিয়ে রাখব জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই ৪৩ রানের ইনিংসটি। কারণ দল সিরিজে ভালো করেছিল। দল ভালো না করলে ব্যক্তিগত সাফল্য ম্লান হয়ে যায়। আর একদিনের ম্যাচ বললে, কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০০০ সালের মিনি বিশ্বকাপে গফ-ক্যাডিককে খেলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা ৬২ রানের ইনিংস।
অভিষেক টেস্টের সেই রেকর্ড
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই রেকর্ড এখনো আপ্লুত করে। কারণ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই সিরিজের প্রথম টেস্টের একাদশ থেকে বাদ পড়েছিলাম। পরে ধারাবাহিক পারফর্ম করেছিলাম।
আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে বিদায় নেয়ার সুযোগ হয়নি। তবে প্রীতি ম্যাচে সাবেক সতীর্থদের দেয়া ‘গার্ড অব অনার’ ছুঁয়ে গেল ‘লড়াকু’ জাভেদকে। ছবি: শামসুল হকদীর্ঘ ক্যারিয়ারের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
প্রাপ্তি অনেক। তবে কিছু অপ্রাপ্তি তো ছিলই। আর অপ্রাপ্তি ছিল বলেই সাফল্য পেতে কঠোর পরিশ্রম করেছি। সবার অভীষ্ট লক্ষ্য ভালো পারফরম্যান্স করা। সামান্য ব্যর্থ হলেই বাদ পড়ে যেতাম। তখন ঘরোয়া লিগগুলোয় পারফর্ম করে আবারও ফিরে আসতাম! কখনোই দলে নিশ্চিত ছিলাম না। এ কারণে আমার ২৫ বছরের ক্যারিয়ারটা সব সময়ই সংগ্রামী ক্যারিয়ার। সব সময় সর্বোচ্চ ঢেলে দেয়ার চেষ্টা করেছি। এর মাঝেও কিছু অপ্রাপ্তি রয়েছে। যেমন-১৯৯৯ বিশ্বকাপ, বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট খেলতে পারিনি। এ ছাড়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টে খেলতে পারিনি। তবে ২০০৭ বিশ্বকাপ খেলায় সে আক্ষেপ অনেকটা ঘুঁচেছে। সেবার ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছি আমরা। আমার জন্য খুব স্মরণীয় একটি ঘটনা রয়েছে। যেদিন (১৭ মার্চ ২০০৭) ভারতকে হারালাম ওই দিনই আমার ছেলের জন্ম হলো! ২০০৫ সালে ইংল্যান্ড সফরের আগে বলা হয়েছিল, এটি জাভেদ ওমরের শেষ সিরিজ। সেবার ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ জিতে ভালোভাবেই ফিরে এসেছিলাম। অতটা প্রতিভাবান খেলোয়াড় ছিলাম না, তবে খুবই পরিশ্রমী ছিলাম। কঠোর পরিশ্রমই আমাকে এত দূর টেনে এনেছে। খেয়াল করবেন, আমার চেয়ে প্রতিভাবান খেলোয়াড় এসেছে। কিন্তু এত দিনের ক্যারিয়ার গড়তে পারেনি।
এসে গেল বিদায়বেলা
বিদায়বেলায় সবাইকে ধন্যবাদ। সংবাদমাধ্যম আমাকে নিয়ে নেতিবাচক লিখেছে। সেগুলোকে ইতিবাচকভাবেই নিয়েছি। এসবে ভেঙে পড়লে এত দূর আসতে পারতাম না। আমি সব সময় দলের জন্যই খেলেছি। দীর্ঘক্ষণ উইকেটে থাকা ও বড় ইনিংস খেলার চেষ্টা করেছি। মাঠে খেলে বিদায় নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। বিশেষ করে জাতীয় দলে খেলে বিদায় নেওয়ার ইচ্ছা সবারই থাকে। সেটা না হলেও প্রত্যাশা ছিল, প্রিমিয়ার কিংবা জাতীয় লিগে খেলে বিদায় নিতে। সার্বিক পরিস্থিতিতে সেটা হলো না। তবে আজ বিদায়ী ম্যাচে চার প্রজন্মের সঙ্গে খেলেছি। এটিও ভোলার নয়। ফারুক ভাই, বুলবুল ভাই থেকে শুরু করে আজকের তামিম-সাকিবের সঙ্গেও খেলেছি। বিদায়লগ্নে চার প্রজন্মের প্রতিনিধিরা আজ মাঠে বিদায় দিতে এসেছিল। আমার স্ত্রী-সন্তান এসেছিল। এসব মুহূর্ত ভোলার নয়। বারবার আবেগ ছুঁয়ে যায় মনে।
অবসরে জীবনের ভাবনা
বোর্ডে কিছু রাজনীতিকের হম্বিতম্বি দেখে একটা সময় খুব মন খারাপ হতো। তবে বর্তমান বোর্ডে এটি কম দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড যদি ডাকে, যথাযথ সম্মান দেয়, সে ক্ষেত্রে নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নতুন প্রতিভাবান ক্রিকেটারের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।