দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ। এখন অপেক্ষা শুধু ভোট গ্রহণের দিনটির। তবে এবারের নির্বাচনে থাকছে না দশটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব হলো প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণ না করা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার ফলে ওইসব আসনে ভোট না হওয়া, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অনুপস্থিতি, পাঁচ জেলায় সেনা মোতায়েন না করা, পাঁচ কোটি ভোটারের অনুপস্থিতি, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার না করা, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না থাকা, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের নজরদারি না করা ও পাঁচ জেলায় ছুটি না থাকা।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হবে আগামী ৫ জানুয়ারি। ইতিমধ্যে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিল, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের কাজগুলো শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। আর শুক্রবার সকাল ৮টায় শেষ হয়েছে নির্বাচনি প্রচারণাও।
bd}bnpবিরোধী দল বিএনপির অংশ না নেয়া : নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হওয়ায় এ নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপিসহ ১৮ দল। গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বিএনপিসহ ১৮ দল আন্দোলন করে আসছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রপতি স্পিকার আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। পরবর্তীতে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের জন্য বিদেশি কূটনৈতিকসহ বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরাও উদ্যোগ নেন। ইতিমধ্যে সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ সংবিধানের আলোকে নির্বাচন করার পক্ষে অনড়। এর ধারাবাহিকতায় দুই দলের সমঝোতা ছাড়াই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
ভোটহীন ১৫৩ আসন : দেশের ইতিহাসে নির্বাচনের সব রেকর্ড পেছনে ফেলে নতুন রেকর্ড হতে যাচ্ছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ইতিমধ্যে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সংশ্লিষ্ট আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তারা।
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, এবারের নির্বাচনে মোট এক হাজার ১০৭ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে বৈধ প্রার্থী ছিলেন ৮৮০ জন। এর মধ্যে ২৯৭ জন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিলে মোট ৫টি দল থেকে ১৫৩টি আসনের ১৫৩জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে ১৫৩ আসনে ভোট গ্রহণ করতে হচ্ছে না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের মধ্যে জাতীয় পার্টির রয়েছে ২১জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) তিনজন, জাতীয় পার্টির (জেপি) একজন, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির দুইজন ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১২৬ জন প্রার্থী।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বহুল আলোচিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের সময় ৪৯ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ১১ জন, জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে ১১ জন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ১৮ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর ২০০৭ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনে মাত্র ১৮ আসনে একক প্রার্থী ছিলেন।
বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অনুপস্থিতি : সব দল অংশগ্রহণ না করায় এবারের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও রাশিয়া। তা ছাড়া উদ্বেগ জানিয়েছে বিভিন্ন পর্যবেক্ষক সংস্থা।
armyপাঁচ জেলায় থাকছে না সেনা : এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের বাইরে থাকছে ৫ জেলা। প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এসব জেলায় সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে না। জেলাগুলো হলো শরিয়তপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, জয়পুরহাট ও চাঁদপুর।
ভোট দিচ্ছেন না পাঁচ কোটি ভোটার : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাঁচটি জেলার মোট ১৫টি আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এসব জেলায় ভোটগ্রহণ করতে হবে না।
৩০০ আসনের জন্য তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে নয় কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজর ৯৭৭ জনের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার কথা ছিল। কিন্তু ১৫৩ আসনে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে না বলে প্রায় পাঁচ কোটি ভোটারকে এবার ভোট দিতে হচ্ছে না।
evm (Electronic Voting Machine)ব্যবহার হবে না ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) : দশম জাতীয় সংসদে এবার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হচ্ছে না বলে ২০১৩ সালের ৯ জুন নির্বাচন কমিশানার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব) জাবেদ আলী বলেছিলেন। এর আগে পরীক্ষামূলকভাবে এ বছরের ২৫ জুন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশেন নির্বাচন করা হয়।
২০১০ সালের চট্টগ্রামে আংশিকভাবে ব্যবহৃত হয় ইভিএম। তারপর ২০১১ সালে এটি ব্যবহার করা হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। ২০১২ সালের শুরুতে পুরোদমে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ও নরসিংদী পৌরসভার নির্বাচনে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আবার রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আংশিকভাবে ব্যবহার করা হয় ইভিএম।
নিবন্ধনহীন জামায়াতে ইসলামী : ২০১৩ সালে বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের বেঞ্চ জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। গত ২ নভেম্বর জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
jamaat e islami bangladesh X 2পরে ৬ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পৌঁছে। ৭ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন জানায়, উচ্চ আদালতের রায়ে জামায়াতে ইসলামী এখন আর নিবন্ধিত দল নয়। এ কারণে নির্বাচনে দলটি ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক নিয়ে আর অংশ নিতে পারবে না।
২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতকে অস্থায়ী নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন। এই নিবন্ধনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ জন। ওই রিটের ওপর জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। তবে দলটির পক্ষ থেকে নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে।
জামায়াতের আইনজীবী ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন এটিএন টাইমসকে জানান, হাইকোর্টের দেওয়া জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না থাকা : সংবিধানের ১৫ তম সংধোধনী পাস করে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের ৫৮ (ক) অনুচ্ছেদে থাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। তাই এবার নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে নির্বাচনকালীর পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভা দিয়ে। এর আগে অবশ্য ১৯৯১ ,১৯৯৬ ,২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমেই নির্বাচন করা হয়েছিল।
বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সাড়া না পাওয়া : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের সাড়া পাওয়া যায়নি। এ নির্বাচন ও সরকারের অবস্থান সম্পর্কে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের অবহিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ নিয়ে তিনি গত ২৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় জাপান, কোরিয়া, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউএনডিপির প্রতিনিধিদের নিয়ে মতবিনিময় করেন। তবে এ নির্বাচনে এসব দেশের রাষ্ট্রদূতরা সাড়া দেননি।
থাকছে না পাঁচ জেলার সরকারি ছুটি : এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের বাইরে থাকছে ৫ জেলা। প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এসব জেলায় দেওয়া হচ্ছে না কোনো ছুটি। এগুলো হলো-শরিয়তপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, জয়পুরহাট ও চাঁদপুর ।