ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ও নেতাদের গ্রাসে চলে গেছে ঢাকার ১ দশমাংশের সমপরিমাণ জমি। এদের সংখ্যা মাত্র ৮ জন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে সম্প্রতি তাদের সম্পত্তির যে হিসাব দিয়েছেন তা পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এই ৮ জন সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতার সম্পত্তির ব্যাপারে এক তদšত্ম প্রতিবেদনে জমির প্রতি তাদের লালসার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে গত ৫ বছরে এসব আওয়ামী লীগ নেতা যেভাবে পেরেছেন এক রকম জমির ওপর আগ্রাসন চালিয়েছেন।
৫ বছর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী এই ৮ জন আওয়ামী লীগ নেতার মোট জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ৭১.৪১৭ একর। আর বর্তমানে তাদের জমির পরিমাণ ৩,৫০৮ একর। অর্থাৎ গত ৫ বছরে তাদের জমির পরিমাণ বেড়েছে ৩৪৩৬ একর। তবে কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনী হলফনামায় এসব আওয়ামী লীগ নেতার জমির যে পরিমাণ প্রকাশ করা হয়েছে প্রকৃত পরিমাণ এরচেয়ে আরো অনেক বেশি।
প্রকৃত পরিমাণ যাই হোক না কেনো নির্বাচনী হলফনামায় এসব আওয়ামী লীগ নেতা তাদের জমির যে পরিমাণ প্রকাশ করেছে তার পরিমাণই রাজধানী ঢাকার এক দশমাংশের সমান। রাজধানী ঢাকার জমির পরিমাণ ৩১,৬৩০ একর। আর এই আটজন আওয়ামী লীগ নেতার জমির পরিমাণ ৩,৫০৮ একর।
সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান, ঢাকার মিরপুরের সংসদ সদস্য আসলামুল হক আসলাম, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, সাবেক স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর এই আটজন আওয়ামী লীগ নেতা গত ৫ বছরে এই বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হন।
কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের অনেক সিনিয়র নেতা জমির দিকে না ঝুঁকে ভবিষ্যতে আরো বেশি আয়ের আশায় অন্য কোনো নিরাপদ বিনিয়োগের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অনেকে আবার আয়কর ফাঁকি দেয়ার জন্য বড় বড় মাছের খামারের দিকে নজর দিয়েছেন। কারণ মাছ থেকে অর্জিত আয়ের উপর কোনো শুল্ক দিতে হয় না। নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামা অনুযায়ী ৭ জন সংসদ সদস্যের মৎস চাষ থেকে বার্ষিক আয় হয় ৩৪ কোটি টাকা। এদের মধ্যে দুজনেরই এই খাত থেকে বার্ষিক আয় ২৭ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস, নূরই আলম চৌধূরী, ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ, মান্নান খান এবং মাহবুবুল আলম হানিফসহ ১০ম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আরো ৩ জন প্রার্থী, এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, দিদারুল আলম, তালুকদার আব্দুল খালেকের মৎস খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে ২০১৩ সালের নির্বাচনী হলফনামা থেকে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদারের কৃষি জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ২০ একর। অথচ গত ৫ বছরে তার কৃষি জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৮৬৫ একর। বিস্ময়করভাবে ৫ বছরে তার জমির পরিমাণ বেড়েছে ১৪৩ গুণ। দেশের বৃহত্তম ইপিজেড অঞ্চল কোরিয়ান ইপিজেড যার আয়তন আড়াই হাজার একর। মাহবুবুর রহমান তালুকদারের কৃষি জমির পরিমাণ এই ইপিজেড এলাকার চেয়েও বেশি। মাহবুবুর রহমান বর্তমানে দেশের সর্ববৃহৎ হাউজিং প্রজেক্টের মালিক। তবে তার বিরুদ্ধে নদী ভরাট ও অবৈধভাবে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। হলফনামায় সাবেক এই পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী তার কৃষি জমির মূল্য ৭০.১৪ লাখ টাকা উল্লেখ্য করলেও নিরপেক্ষ সূত্র মতে তার জমির মূল্য হাজার কোটি টাকা।
২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদের রাজধানী ঢাকার পূর্বাচলে ৮ ডেসিমালের একটি প্লটসহ তার মোট জমির পরিমাণ ছিল ১৪.৪ ডেসিমাল। আর বর্তমানে তার জমির পরিমাণ ৩১,০৩২ ডেসিমাল। এরপাশাপাশি ৮.০৯৮ ডেসিমালের উপর তার একটি ভবন রয়েছে। চট্টগ্রামের সবচেয়ে দামি এলাকায় হাছান মাহমুদের জমি রয়েছে ৯.৬ ডেসিমাল। এছাড়া চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকা খুলশিতে তার একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে যার মূল্য ধরা হয়েছে ৪৭.৮৩ লাখ টাকা। বর্তমানে হাছান মাহমুদের স্ত্রীর নামে গাজীপুরে অতি উচ্চ মূল্যের ৪.৮ ডেসিমাল ও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ২৮৮ ডেসিমাল জমি এবং ঢাকার সোনারগাঁ রোডে ৬০০০ স্কয়ার ফিটের দুটি অফিস স্পেস রয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী ঢাকার মিরপুরের সংসদ সদস্য আসলামুল হকের জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ৬ একর। আর বর্তমানে তিনি ১৪৫ একর জমির মালিক। তবে আসলাম সাম্প্রতিক হলফনামায় তার কয়েকটি বিদ্যুৎ প্লান্টের তথ্য উল্লেখ করেন নি। অথচ এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র তার নিজস্ব জমিতে করা হয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুরের জমির পরিমাণ ছিল ৪৫ একর। গত ৫ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ একরে। এছাড়াও তার ২৪.৫ ডেসিমালের একটি প্লট রয়েছে। তবে নিরপেক্ষ সূত্র মতে, বান্দরবান সদর উপজেলা, লামার রাজবিলা, কুহালং এবং টংকাবটি ইউনিয়ন এবং নাইখংছড়ি উপজেলায় তার বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক হানিফ গত ৫ বছরে ৪.৯৫ কোটি টাকা দিয়ে ৭০ একর জমি ক্রয় করেছেন। এরমধ্যে কমপক্ষে ৬৭ একর জমি দেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের ২০০ মিটার এলাকার মধ্যে। এছাড়া গাজীপুরে তার ৩ একর জমি রয়েছে। ২০১৩ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী হানিফের মৎস খামার থেকে বার্ষিক আয় ৩.২৭ কোটি টাকা।
২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ০.০৮৫ একর। বর্তমানে তিনি ৭.০৮ একর জমি ও রাজধানীতে ৩,২৩৮ স্কয়ারফিটের একটি ফ্লাটের মালিক। তবে সূত্র মতে বাবু তার নির্বাচনী এলাকা রুপগঞ্জ ও আড়াই হাজার অঞ্চলের অনেক মূল্যবান জমি এরই মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান ও স্ত্রীর মাত্র ২.৪৫ টাকা মূল্যের কৃষি জমি ছিল। আর বর্তমানে তার ভূ -সম্পত্তির মূল্যমান দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। অথচ ২০০৮ সালের হলফ নামায় মান্নানের কোন ফ্লাট বা বাড়ি ছিল না। বর্তমানে ৩.৬৪ কোটি টাকা মূল্যের তার দুটি ফ্লাট ও একটি বাড়ি রয়েছে। ২০১৩ সালের হলফনামায় মান্নান দেখিয়েছেন মৎস খামার থেকে তার আয় ১কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং তার স্ত্রীর আয় ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। অথচ ২০০৮ সালের আগে তাদের কোন মৎস খামারই ছিল না।
গত নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী সাবেক এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ০.১০ একর। বর্তমানে তিনি এবং তার স্ত্রী ৩.৩৬ একর জমির মালিক। এর মধ্যে ১.৯৪ একর অকৃষি জমি এবং ১.৬২ আবাদী জমি রয়েছে। তাছাড়া নানকের রাজধানী ঢাকায় ১কোটি ৩০ টাকা মূল্যের একটি বাড়ি রয়েছে। অথচ ২০০৮ সালের আগে কেবল তার স্ত্রীর নামে একটি ১,৮৭৪ স্কয়ারফিটের একটি ফ্লাট ছিল।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস এবং তার স্ত্রী বর্তমানে ১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা মূল্যের দুটি মৎস খামারের মালিক। অথচ ২০০৮ সালের আগে তাদের কোন মৎস খামারই ছিল না। তাছাড়া তাপসের ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা মূল্যের ১০ কাঠা জমি এবং ১ কোটি ৪ লাখ টাকা মূল্যের একটি ফ্লাট রয়েছে।
নূর ই আলম চৌধুরীর বর্তমানে শেয়ার ব্যবসা ও মৎস চাষ থেকে বার্ষিক আয় ১২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অথচ ২০০৮ সালের আগে এই দুটি খাত থেকে তাদের কোন আয় ছিল না।
আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার মৎস খাত থেকে বার্ষিক আয় ৫ কোটি টাকা। অথচ ২০০৮ সালের হলফনামা অনুযায়ী তার বার্ষিক আয় ছিল ৩০ লাখ টাকা।
উৎসঃ ডেইলি স্টার