নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। সারা দেশের ভোট কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে নির্বাচনী সামগ্রী। প্রস্তুত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে মাঠে সেনাবাহিনী, বিজিবি সদস্যরা। ভোট প্রার্থনা করে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনে থাকা অন্য ১১ দলের ৫টি দলের প্রধানরাও বাংলাদেশ টেলিভিশনে রেখেছেন নির্বাচনী ভাষণ। নাগরিকদের মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে নির্বাচন কমিশন বলেছেন, ‘ভোট আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার… দেখে-শুনে-বুঝে আপনার ভোট দিন।’ গত রাতেই নির্বাচনী প্রচারণা শেষ হয়েছে। রোববার সকালে ভোট। তবুও নির্বাচন নিয়ে কাটছে না সংশয়।
বৃহস্পতিবার দিনভর প্রশাসনের সর্বোচ্চ কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে গুঞ্জন ছিল নির্বাচন আটকে যাওয়ার। বিশেষ করে বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার একটি নির্বাচনী জনসভা থেকে ‘নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে’ বলে মন্তব্য করলে নির্বাচন পেছানোর গুঞ্জন তীব্রতা পায়। একই দিন ভারতীয় একটি সংবাদপত্র খবর দেয়, বাংলাদেশের নির্বাচন পেছাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো সচেষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে সরে না এলে দেশগুলো বাংলাদেশের বিষয়ে আরও কঠোর হবে বলেও নানা ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিদেশি শক্তিগুলো বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করতে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এ অবস্থায় আটকে যেতে পারে নির্বাচন। এর আগে সপ্তাহের শুরুর দিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন, টিআইবি, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন এক অনুষ্ঠান থেকে নির্বাচন স্থগিত করার দাবি জানিয়ে বলে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এখনও পেছানো সম্ভব। পরে আইন বিশেষজ্ঞরাও ওই মত সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন। সব মিলিয়ে নির্বাচনের একেবারে শেষ মুহূর্তেও নির্বাচন পেছানোর গুঞ্জন নতুন মাত্রা পায়। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বিদেশি শক্তিগুলো মনে করে, আইনি পদ্ধতি অনুসরণ করে এখনও নির্বাচন পেছানো সম্ভব। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবম সংসদ ভেঙে দেয়ার ঘোষণা দিলে সাংবিধানিক পথেই নির্বাচন ৯০ দিন পিছিয়ে দেয়া সম্ভব। এছাড়াও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পরও এরই মধ্যে যাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে তারা আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। তারা প্রার্থিতা বাতিল ও নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে আদালত অধিকতর শুনানির জন্য দিন ধার্য করতে পারেন। শুনানি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের ওপর জারি করতে পারেন নিষেধাজ্ঞা। অন্যদিকে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরই মধ্যে যারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন তারাও শরণাপন্ন হতে পারেন আদালতের। তবে আজ ও শনিবার আদালতের নিয়মিত বেঞ্চ থাকবে বন্ধ। অবকাশকালীন বেঞ্চ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু পরপর দু’দিনের ছুটি শেষ হওয়ার পরদিনই নির্বাচনÑ সেক্ষেত্রে নির্বাচন পেছানোর কোনো আইনি অনুসরণ কতটুকু সম্ভব এ নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন পেছানোর বিষয়ে শেখ হাসিনার সরকার এরই মধ্যে যথেষ্ট নমনীয়তা দেখাচ্ছে। বিএনপিও নির্বাচন পেছালে তাতে অংশ নেয়ার ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে। এখন সমঝোতা আটকে আছে কেবল দু’পক্ষের কাছে ‘সম্মানজনক’ একটা পন্থা বের করার ওপর। যেহেতু দু’পক্ষ নমনীয়, তাই চেষ্টা চালালে শেষ মুহূর্তেও নির্বাচন পেছানোর ‘সম্মানজনক’ একটা পন্থা বের করা সম্ভব হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র আলোকিত বাংলাদেশকে জানিয়েছে, নির্বাচন পেছালে তা আগামী ৯০ দিনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। এ সময়ে ক্ষমতায় থাকবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন কেবল নির্বাচনের নতুন তফসিল ঘোষণা করবে। মনোনয়নপত্র দাখিল, যাচাই-বাছাই, প্রার্থিতা প্রত্যাহার, নির্বাচনী প্রচারণাÑ এ প্রক্রিয়াগুলোই হবে কেবল একেবারে নতুন। শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচন হলেও বিএনপি নির্বাচনে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়ার গুঞ্জন সত্য হলেই কেবল শেষ মুহূর্তে স্থগিত হবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব কার্যক্রম।
শেষ মুহূর্তে এসে নির্বাচন পেছানো সত্যি সম্ভব কিনা এ প্রশ্নে ড. আকবর আলি খান বৃহস্পতিবার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিবদমান পক্ষগুলো সমঝোতায় এলে সবই সম্ভব। তবে নির্বাচনের একেবারে ২৪ ঘণ্টা আগে এটা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। নির্বাচন পেছানোর বিষয়টি এখন সম্পূর্ণ নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।
আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ভাষণ শুনলাম। এরপর আর নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। বাতাসে যা ভাসছে, তা অতি আশাবাদীদের কল্পনা মাত্র।
একই বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতায় অনেক কিছুই সম্ভব হয়। তবে শেষ ঘণ্টায় নির্বাচন আটকে যেতে পারেÑ এমন ভাবনার সঙ্গে একমত পোষণ করার কোনো দৃশ্যমান কারণ আমি অন্তত দেখছি না। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে নির্বাচন পেছানো সম্ভব। অসম্ভব বলে কিছু নেই।