বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এবং সুশীলসমাজসহ দেশ-বিদেশের তুমুল বিরোধিতার মুখেও একতরফা নির্বাচনের পথেই হাঁটছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সবার মতামত উপেক্ষা করে আগামী রোববার যেকোনো মূল্যে নির্বাচন করার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে দলটি। তাদের মতে, নির্ধারিত তারিখে নির্বাচন না হলে দেশ সাংবিধানিক সঙ্কটে পড়বে। তাই বিরোধী জোটসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলো অংশ না নিলেও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে গিয়েই এ নির্বাচন। আর যা হওয়ার নির্বাচনের পরই হবে। প্রয়োজনে নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠন করে বিরোধী দলের সাথে সমঝোতা হলে সংসদ ভেঙে দিয়ে আবার নির্বাচন দেয়া হবে।
অন্য দিকে একতরফা নির্বাচন বন্ধ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে টানা আন্দোলন করে যাচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। এতে সারা দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বিরোধী জোটের এ কর্মসূচি দমন করতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই মরছে সাধারণ মানুষ। অর্থনীতি পড়েছে চরম হুমকির মুখে। তাই দেশের আরো বিপর্যয় ঠেকাতে প্রার্থীবিহীন এ নির্বাচন অবিলম্বে স্থগিতের দাবি জানিয়ে আসছেন দেশের সুশীলসমাজের প্রতিনিধিসহ বিশিষ্ট নাগরিকেরা। একই অবস্থানে রয়েছে বিভিন্ন দাতা সংস্থাসহ উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নহ বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। নির্বাচন স্থগিত করে বিরোধী দলকে নিয়ে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে তারা। এ অবস্থায় সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও আগামী ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য একতরফা এ নির্বাচন স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, দেশের স্বার্থে এ নির্বাচন বন্ধ করতে হবে। এতে সাংবিধানিক কোনো বাধাও নেই। আর গায়ের জোরে নির্বাচন করা হলে আওয়ামী লীগের গায়ে নতুন একটি কলঙ্ক লাগবেÑ যা তাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, দশম নয়, এখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েই ভাবছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা মনে করছেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেড় শতাধিক আসনে ক্ষমতাসীনদের জয়লাভের পর নতুন করে সরকার গঠন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেখানে বিরোধী দলের ফেরার আর কোনো পথ নেই। তাই এ মুহূর্তে কোনো রকম সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন স্থগিত করে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কোনো সুযোগ নেই। বিরোধী দলের অংশগ্রহণের জন্য যদি এ নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া হয় তবে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়বে। এতে ভবিষ্যৎ নির্বাচনে বিরোধী দলের বিজয় আরো নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দিলে দলের এমপি-মন্ত্রীসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়বেন। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালী নেতারা হামলার মুখে পড়ছেন। গতকালও রাজশাহীতে দলের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের ওপর ককটেল হামলা হয়েছে। এর আগে বগুড়ায় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও ত্রাণমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সমাবেশে একইভাবে হামলা হয়। তাই দশম নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করে একাদশতম নির্বাচনের ব্যাপারে বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করার পক্ষে তারা। দলের সিনিয়র একাধিক নেতা সরকারের এমন মনোভাবের কথা জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা আলাপকালে জানান, সরকার বর্তমানে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’ রয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমনপর্যায়ে চলে গেছে যাতে সরকারের পিছু হটার আর সুযোগ নেই। তাই যেভাবেই হোক সরকার দশম জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গেজেট প্রকাশ করবে। নতুন করে মন্ত্রিসভাও গঠন করে একপর্যায়ে নতুন সরকার গঠনের দিকে যাবে আওয়ামী লীগ। তখন বিরোধী দলের আর কিছুই করার থাকবে না। তবে বিরোধী দল আন্দোলনের মাত্রা আরো তীব্র করলে সরকারও দমনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেবে। বিরোধী নেতাকর্মীদের দমনে চলমান যৌথ অভিযান নির্বাচন পর্যন্ত অব্যাহত রাখা হবে। একপর্যায়ে বিএনপি-জামায়াত-শিবির দেখামাত্র গুলির প্রকাশ্য নির্দেশ দেয়া হতে পারে। এসব বিষয় সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। এভাবে যত দিন ক্ষমতা আকড়ে থাকা যায় তার শেষ পর্যন্ত চেষ্টা হবে। তবে বিরোধী দল দমনের পাশাপাশি বিকল্প চিন্তাও করে রেখেছে সরকার। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে বাধ্য হলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হবে। আর তাতেও ব্যর্থ হলে বিরোধী দলবিহীন দশম জাতীয় নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার শর্তে ক্ষমতা থেকে সটকে পড়া হবে। এসব বিষয়কে সামনে রেখেই এগোচ্ছে সরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষপর্যায়ের একজন নেতা এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা থেকে কোনোভাবেই পিছু হটবেন না। গত পাঁচ বছরে কোনো সিদ্ধান্ত থেকে তার পিছু হটার রেকর্ডও নেই। তাই এবারও ব্যতিক্রম হবে না। গত বুধবার রাজধানীতে এক নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন, আওয়ামী লীগের হারার রেকর্ড নেই। তাই এবারো আমরা মাথা নত করব না।
আরেক নেতা বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা ’৯৬ সালে একতরফা নির্বাচন করে আজ তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন। আমাদের নেত্রী এ দিক থেকে পিছিয়ে থাকবেন কেন? ক্ষমতা যদি ছাড়তেই হয় তবে এবারের একতরফা নির্বাচনকেও বৈধতা দিতে হবে। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পাবেন। এবার সে সুযোগ এসেছে। তাই ভবিষ্যতে যা-ই হোক না কেন এ সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা হবে না।
এ দিকে একতরফা নির্বাচন নিয়ে সরকারের অনমনীয় অবস্থান এবং বিরোধী দলের টানা হরতাল-অবরোধে দেশ অচল হয়ে পড়েছে। নির্বাচন ইস্যুতে প্রতিবেশী একটি দেশ ছাড়া প্রায় সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় অবিলম্বে নির্বাচন স্থগিতের দাবি জানাচ্ছেন দেশের সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা। সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, প্রার্থীবিহীন একতরফা এ নির্বাচন পেছাতে সাংবিধানিক কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। তাই দেশের স্বার্থে নির্বাচন স্থগিত করে বিরোধী জোটকে সাথে নিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা উচিত।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টর রফিক-উল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগের ঘাড় যত দিন শক্ত থাকবে তত দিন একতরফা নির্বাচনের কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে হবে। এই কলঙ্ক থেকে বিরত থাকতে হলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করতে হবে।
তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৪ এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে ৫ তারিখের নির্বাচন স্থগিত করতে হবে এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে দেশের এই রাজনেতিক সঙ্কট কাটতে পারে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ৫ তারিখের নির্বাচনের পরে যদি সরকার টিকতে না পারে তাহলে রাজনৈতিক পরাজয় হতে পারে। তবে সরকার কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে বেআইনি ও অনৈতিকভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য একতরফা নির্বাচন করছে।
তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং ’৯৬ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একতরফা নির্বাচন করেন। তারা ক্ষমতায় টিকতে পারেননি। ড. মালিক বলেন, একতরফা নির্বাচন থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মনমানসিকতার পরিবর্তন দরকার। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের তা নেই। আমাদের জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলো, এ রকম নেতৃত্বকেই আমরা বারবার বরণ করি।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ’৯৬ সালের নির্বাচন এবং আগামী ৫ তারিখের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট এক নয়। বিএনপি বলছে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে নির্বাচনে যাবো। কিন্তু সংবিধানে এ ব্যবস্থা নেই। সাংবিধানিক ধারবাহিকতা রক্ষার জন্য ৫ তারিখের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। এর পরে হয়তো একাদশ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সাথে আলোচনা হতে পারে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, একতরফা নির্বাচন করা দলের জন্য কোনো রাজনৈতিক পরাজয় নয়। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য। কিন্তু তারা জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে নির্বাচনে আসতে রাজি নয়।