আগামী ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর বাংলাদেশে নিরাপত্তা ও কূটনীতি দু’দিক থেকেই পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলে দাবি করেছে ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা। এ অবস্থায় জামায়াতকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে হাসিনা সরকার প্রয়োজনে জরুরি আইন জারি করতে পারে বলেও জানিয়েছে পত্রিকাটি।
বৃহস্পতিবার পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে বলা হয়, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হলে বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে চার মাস পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে সরকার। সেক্ষেত্রে একদিকে নির্বিঘ্নে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব হবে। অন্যদিকে বিরোধীদের লাগাতার হরতাল-অবরোধ বন্ধ হওয়ায় জনজীবন স্বাভাবিক হবে। মানুষও স্বস্তি পাবেন। পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষেও বাংলাদেশ-বিরোধী অবস্থান নেওয়া সহজ হবে না। কিন্তু ঢাকা এ কথা মনে করলেও এই পরিস্থিতি যে দীর্ঘদিন চলতে পারে না, সে কথাই বলা হয় প্রতিবেদনে।
নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বিএনপি অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে গোটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা একপেশে হয়েছে। ১৫৩টি আসনে ইতোমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেছে একজন করে প্রার্থী। এর মধ্যে ১৩২ জনই শাসকদল আওয়ামী লীগের। বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া ‘কার্যত গৃহবন্দি’ বলে দাবি করেছে বিএনপি। বিএনপি’র অনেক নেতাই জেলে রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে পশ্চিমা দুনিয়া। তাই এই দফায় সরকার গড়লেও খুব দ্রুত দেশে রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে আরো একটি সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ ঢাকাকে দিচ্ছে নয়াদিল্লি। গোটা পরিস্থিতি নিয়ে আওয়ামী নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনার জন্য ৫ তারিখের আগেই ভারতের কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে ঢাকায় পাঠানোর কথা ভাবছে নয়াদিল্লি।
সব মিলিয়ে তাই একদিকে যেমন সীমান্ত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কোমর বাঁধা হচ্ছে, শরণার্থীদের প্রশ্নে কিছুটা মানবিকতার পথেই হাঁটার কথা ভাবা হচ্ছে, অন্যদিকে কূটনৈতিক স্তরে হাসিনা সরকারকেও বোঝানো হচ্ছে, পরিস্থিতির রাশ ধরার জন্য সংবেদনশীল পদক্ষেপ করতে হবে। কেন না বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘতম সীমান্তের ভাগীদার ভারতের পক্ষেও অবস্থাটা আদৌ অনুকূল নয়। বিষয়টির নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক দু’রকম দিকই রয়েছে বলে মনে করছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (বিদেশ মন্ত্রক)। সীমান্ত সিল করে দেওয়া অথবা শরণার্থীদের জন্য ব্যবস্থা করা আপতকালীন তৎপরতা হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদিভাবে এই চাপের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়াটা নয়াদিল্লির কাছে যেমন সহজ নয়, তেমন কাম্যও নয়।
পূর্ব উপকূলকে কাজে লাগিয়ে ভারতে জঙ্গি পাচার করার জন্য মুখিয়ে রয়েছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। সুতরাং বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদিভাবে জঙ্গিপনার দিকে হাঁটুক, এটা কিছুতেই চায় না সাউথ ব্লক। আর তাই আমেরিকার সঙ্গে সাম্প্রতিক আলোচনায় বিদেশসচিব সুজাতা সিংহ জানিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামীকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থেই জামায়াতকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা প্রয়োজন।
কিন্তু এ নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পরও যুক্তরাষ্ট্র সুর নরম করেনি, তা এখন স্পষ্ট। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা খোলাখুলিই জানিয়েছেন, নির্বাচন হওয়া উচিত অবাধ এবং নিরপেক্ষ। আসন্ন ভোট নিয়ে আওয়ামী লীগের ভূমিকায় যে আমেরিকা আদৌ সন্তুষ্ট নয়, সে কথাও বারবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে প্রতিবেদন সম্প্রতি দিল্লিতে পৌঁছেছে, তাতে বলা হচ্ছে, ‘এই নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে তার সঙ্গে চূড়ান্ত অসহযোগিতার পথে হাঁটবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। কোনো কারণে এই সরকার পড়ে গিয়ে জামায়াত সমর্থিত বিএনপি সরকার যদি ক্ষমতায় আসে, তা হলে বিপুল সংখ্যক অনুপ্রবেশকারী মোকাবিলার জন্য ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
চলতি পরিস্থিতির মোকাবিলায় হাসিনা সরকারকে জরুরি অবস্থা জারি করতে হতে পারে, এমন কথাই বলছে ওই রিপোর্ট। আইন শৃঙ্খলার অবনতি হলে সে দেশের সংবিধান অনুসারে ৪ মাস পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে সরকার। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ হিংসামুক্ত আবহাওয়ায় একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার অবকাশ পাবেন। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন, জিনিসের অগ্নিমূল্যও কমবে। যুদ্ধাপরাধীদের একের পর এক ফাঁসি হলে হয়তো আবার উন্মত্ত হতে পারে জামায়াত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থাকে আরও কিছু দিন বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে সরকার। পশ্চিমের পক্ষেও বিরোধিতা করা কঠিন হবে।’
কিন্তু এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলুক, ভারত তা চাইছে না। আর সে কথাটাই বোঝানোর কথা ভাবা হচ্ছে শেখ হাসিনার সরকারকে।