বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে যে রাজনৈতিক সংঘাতের অবসান ঘটবে- এমন নিশ্চয়তা নেই কূটনীতিকদের কাছে। বরং নির্বাচনের পরেও দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের আশংকা করছেন তারা। তাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত ও পরে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে যেভাবেই হোক দ্রুত সমঝোতা চায় আন্তর্জাতিক মহল।
কূটনীতিকরা মনে করছেন, সমঝোতা ছাড়া এ সংকট থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারবে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ক্রমশ অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে- এমনটি বিবেচনায় নিয়ে কয়েক দিনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারত কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েয়েছ। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন এবং দিল্লির কূটনীতিকরা কয়েক দিনে বেশ সরব হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে যেহেতু নিজেদের স্বার্থ জড়িত, তাই সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন বলে একমত তারা। এ জন্য আন্তর্জাতিক মহল একযোগে কাজ করা এবং প্রয়োজনে চাপ সৃষ্টি করার ব্যাপারেও একমত হচ্ছে।
বাংলাদেশের চলমান সংকট নিয়ে দিল্লি তার আগের অবস্থানে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা উত্তপ্ত হওয়া এবং বাংলাদেশে ভারতবিরোধী জনমত বৃদ্ধি পাওয়ায় এ পরিবর্তন এনেছেন তারা। বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে যে মতপার্থক্য ছিল তা কয়েক দিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদ পরিষ্কার করেন। তিনি সেদেশের দৈনিক পত্রিকা দ্য হিন্দুকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, যেহেতু বাংলাদেশের বর্তমান সংকট নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে মতপার্থক্য রয়েছে, তাই এ ব্যাপারে উভয় দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারছে না। বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের একসঙ্গে কাজ করা দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করতে পারে। তবে মঙ্গলবার থেকে ভারতের অবস্থানে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিনের বিবৃতিতে বিষয়টি উঠে আসে। তিনি জানান, প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে দিল্লির আগ্রহ আছে। কারণ দুই দেশের ভাগ্য পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বিবৃতিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর সংঘাতের বিষয়টির দিকে নজর রাখছে দিল্লি। ভারত আশা করে, একটি শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের মতভিন্নতা দূর করতে সক্ষম হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কোনো উদ্দেশ্য আমাদের নেই। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের মানুষ ও নেতারা একটি সমাধানে পৌঁছতে পারবেন।
সৈয়দ আকবরউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে দীর্ঘ সীমান্ত রেখা রয়েছে। তাই এক দেশে কোনো কিছু ঘটলে অপর দেশ উদাসীন কিংবা নির্বিকার থাকতে পারে না। বাংলাদেশে কি ঘটছে সে বিষয়ে আমাদের যেমন আগ্রহ রয়েছে তেমনি আমাদের দেশে কি হচ্ছে সে বিষয়েও বাংলাদেশের সমান আগ্রহ রয়েছে বলে বিশ্বাস করি। দিল্লি আশা করে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে মতবিরোধ দূর করতে পারবে যা সব বাংলাদেশীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
বাংলাদেশের সংকট নিয়ে কয়েক দিনে কূটনীতিকদের এ তৎপরতা গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, কয়েক দিনে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে সরকারি দলের অবস্থান, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার গৃহবন্দি, আন্তর্জাতিক মহলের নির্বাচন পর্যবেক্ষক না পাঠানো, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করতে সুশীল সমাজের আহ্বান এবং ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন নতুন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। এ অবস্থায় যে সরকার গঠিত হবে তার চেয়ে প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকার চান কূটনীতিকরা। এ জন্য এখনো সমঝোতায় পৌঁছতে প্রধান দুই দলের সঙ্গে আলোচনা করে যাচ্ছেন তারা। এছাড়া সম্প্রতি ভারতের অবস্থান পরিবর্তনও উল্লেখযোগ্য বলে মনে করছেন ড. ইমতিয়াজ।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর যুগান্তরকে জানান, বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় আন্তর্জাতিক মহল। এ জন্য এসব দেশের কূটনীতিকরা প্রধান দুই দলকে বারবার বিষয়টি অবহিত করেছেন। তারা তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন, কিন্তু কাজ করতে হবে এদেশের রাজনীতিবিদদের। সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া আগামী নির্বাচন যে আন্তর্জাতিক মহল মানবে না তা তারা পর্যবেক্ষক না পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন। দেশের ভেতরেই এ নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের এখন পূর্বশর্তই হচ্ছে দুইপক্ষকে কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত হতে হবে। সমঝোতা হলে এখনো সেটি সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দিল্লির অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী জনমত বেড়েছে বলে মন্তব্য করে দ্য হিন্দু ও আনন্দবাজারসহ ভারতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের সংকট ভারতের বাংলাদেশ নীতির প্রতি কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এটা আর গোপন বিষয় নয় যে, দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এবং বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিগত পাঁচ বছরের চেয়ে ভালো সম্পর্ক আর কখনোই ছিল না। তবে বাংলাদেশের এ সংকট উত্তরণে বিরোধী দলের প্রতি নমনীয় হতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিতে পারত দিল্লি। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর মতে, ভারত আশংকা করছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশ আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। ফলে সমস্যা সংকুল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা দিল্লির জন্য আরও জটিল হয়ে পড়বে। কারণ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কার্যত গৃহবন্দি। আরেকজন রাজনীতিক জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও সাবেক সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার পর তাকে কমান্ডোরা ধরে নিয়ে গিয়ে সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করেছে। যদিও এরশাদের জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক। এ নির্বাচনে বড় দলের মধ্যে শুধু আওয়ামী লীগই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। জামায়াতকে নির্বাচনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ৩০০ আসনের সংসদে অর্ধেকেরও বেশি আসনে প্রার্থীরা ইতিমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের জরাজীর্ণ নির্বাচনে বিজয় সেই রকম বৈধতার ধারে কাছেও যেতে পারবে না, যেটি আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২০০৮ সালের জয়ের পর।
ভারতের গণমাধ্যমগুলো বলছে, ৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইসলামী উগ্রপন্থী এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। এই সমীকরণের ফলে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী জনমত অবিশ্বাস্য উচ্চতায় পৌঁছে। কারণ ঢাকা যেভাবে ছাড় দিয়েছে নয়াদিল্লি সেভাবে কিছুই করেনি। যেমন বাস্তবায়ন করেনি তিস্তা চুক্তি।