যদি তবে কিন্তুর ঘুরপাকে দেশ

0
105
Print Friendly, PDF & Email

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর তিন দিন। নির্বাচন সম্পন্নের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এনেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট নির্বাচন পেছানোর দাবিতে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। বিদেশি কূটনীতিকরাও ব্যাপক দূতিয়ালিতে ব্যস্ত রয়েছেন। আর সার্বিক পরিস্থিতিতে সর্বমহলে চলছে নানা ধরনের বিশ্লেষণ। নির্বাচন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তবে, কিন্তু, যদি এ ধরনের অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশবাসীর কাছে। কেউ বলছেন, সবকিছুর পরও যদি নির্বাচন হয়ে যায়, তবে সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে তা ভেবে দেখার বিষয়? আবার কেউ বলছে, নির্বাচন হবে কিন্তু বিশ্ব দরবারের এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। আর একটি মহল বলছে, যদি সব বাধা উপেক্ষা করে সরকার টিকে যায় তাহলে বিশ্বে বাংলাদেশ আরো একবার মডেল হবে। এদিকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে, একটি মহল বলেছিল যদি বিরোধী জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হয় তবে জাতিসংঘ বাংলাদেশ থেকে সৈন্য নেয়া বন্ধ করে দেবে, কিন্তু তা হয়নি বরং জরুরি ভিত্তিতে আরো প্রায় এক হাজার সৈন্য গেছে। একাধিক সূত্র জানায়, গেল বছরের শুরুতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরবর্তীতে নির্বাচনী সরকার নিয়ে প্রধান দুই জোটের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। বিরোধী পক্ষ আন্দোলনে রাজপথে নামে আর সরকার পক্ষ আন্দোলন দমনে সচেষ্ট হয়। এক পর্যায়ে বিদেশি কূটনীতিকরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের কূটনীতিক সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপে বসার আহ্বান অব্যাহত রাখে।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, পরিস্থিতি জটিল পর্যায়ে পৌঁছলে জাতিসংঘ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে। সংস্থার মহাসচিব দু’দলের শীর্ষ পর্যায়ে ফোন করেন উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে। এক পর্যায়ে মহাসচিব বান কি মুন তার বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে ঢাকা পাঠাতে বাধ্য হন। তারানকো এসে দুই প্রধান দলের মধ্যে জমে থাকা বরফ কিছুটা গলিয়ে দুই দফা বৈঠকে বসান।
কিন্তু গত ২০ ডিসেম্বর ইইরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও রাশিয়া পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ঘোষণা দেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তবে এরপরও দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে। আর সঙ্গে রয়েছে দেশি পর্যবেক্ষকও। কিন্তু তারপরও বিরোধী জোট আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।
সংশ্লিষ্টরা আরো বলছেন, আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচন প্রস্তুতি নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে নানা ধরনের গুঞ্জন চলছে দেশজুড়ে। এ গুঞ্জনে বলা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশিরা শেষ মুহূর্তে কারিশমা দেখাতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। পাশাপাশি সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে অনেকেই নির্বাচন পেছানোর দাবি জানিয়ে আসছেন।
তারা বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে চলমান সংকটের সমাধান আসবে না। যদি এ নির্বাচন হয় তবে দেশ আরো গভীর এবং দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ২৩ বছর ধরে সংঘাতে দুই দল। তবে তারা নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এর মাধ্যমে দেশকে ধ্বংস করছে।
সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মঞ্জুর এলাহী বলেন, নির্বাচন পেছানোর পাশাপাশি দুই দলকে একটি সমঝোতায় আসতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হতে পারে। আর দুই দল যদি ব্যর্থ হয় তবে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা দেশের শাসন ক্ষমতা নিয়ে নিতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, দেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বিদেশে উদ্বেগ অব্যাহত রয়েছে। বিদেশিরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন না। এতে করে বিশ্ববাসীর কাছে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে নির্বাচনের নামে এ ধরনের তামাশা হয়নি। তবে বর্তমান নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে যে কথা হচ্ছে তাতে ইইউসহ বিদেশিরা যদি পর্যবেক্ষক পাঠাত তাই হয়তো অস্বাভাবিক ঘটনা।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা জানিপপের সমন্বয়ক প্রফেসর নাজমুল আহসান কালিমুল্লাহ বলেছেন, বিদেশিরা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর বিষয়টি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। সহিংসতার রাজনীতি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে এর খারাপ প্রভাব অবশ্যই পড়বে।
অন্যদিকে বিদেশিরা পর্যবেক্ষক না পাঠালেও নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান। তিনি বলেছেন, অনেক দেশেরই বর্তমান অবস্থানে আসতে সময় লেগেছে কয়েকশ’ বছর সুতরাং তারা বাংলাদেশকে তাদের দিক থেকে বিবেচনা করলে সেটি অন্যায় হবে।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বিদেশের বিষয়টি সর্বজন স্বীকৃতি। আর সব কিছুকে উপেক্ষা করে যদি এ নির্বাচন হয়ে যায় তাহলে বিশ্ব দরবারে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
একাধিক সূত্র বলছে, তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে রাজনৈতিক সংকট এবং অস্থিরতা আরো বাড়বে। কিন্তু সরকারও তাতে ছাড় দেবে না। তারা দ্বিগুণ উৎসাহে আন্দোলন দমনে ব্যবস্থা নেবে। যদি বিষয়টি বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ভালোভাবে না নেয় তবে তারা ব্যবসা ও বিনিয়োগ বন্ধ করে দিতে পারে।
সূত্র বলছে, কিন্তু সব কিছুর পরও সরকারের কাছে দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসমুক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে। কারণ রাজনৈতিক সংকট নিয়ে যদি এসব গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তাহলে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে মাসুল গুনতে হতে পারে।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সরকার যদি সবকিছুকে উপেক্ষা করে নির্বাচন করে টিকে যায় তবে বিদেশিরা আবারো বিনিয়োগ এবং ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। পাশাপাশি নির্বাচনের শেষে তবে কিন্তু যদি এ ধরনের প্রশ্নের ত্বরিত উত্তর মিলে যাবে।

শেয়ার করুন