নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৫ জানুয়ারি দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু আসলে সেদিন নির্বাচন হবে নাকি সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে এমন সংশয় যেন কাটতেই চাচ্ছে না সাধারণ মানুষের মন থেকে।
যদি অতীতের বিভিন্ন সময়ের আদলে বিরোধী দল বা ভোটারবিহীন একটি প্রহসনের নির্বাচন হয় তাহলে তা দেশের জন্য কতটুকু মঙ্গলজনক হবে এ ভাবনায় তাড়িত রাজনীতি সচেতন মানুষ।
আসন্ন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের বড় দুই দলের নেতৃত্বে সব রাজনৈতিক দলগুলো দুটি জোটে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। নির্বাচন প্রশ্নে এই দুই জোট বর্তমানে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিরোধী দলের এ দাবির কোনো তোয়াক্কা না করে গণতন্ত্র রক্ষার নামে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা দেখিয়ে আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে।
এদিকে দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। পাশাপাশি যেকোনো মূল্যে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে তারা। এরই অংশ হিসেবে কয়েক সপ্তাহ ধরে অবিরাম হরতাল-অবরোধ দিয়ে চলেছে এ জোট। বিরোধী জোটের এসব কর্মসূচি প্রতিহত করতে সরকার দলীয় কর্মী বাহিনী দিয়ে এবং প্রশাসনিকভাবে সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শন করছে। হরতাল অবরোধ বা অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আন্দোলনকামী মানুষের ওপর সরকারদলীয় ছাত্র-যুব ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যরা নির্বিচারে অত্যাচার নির্যাতন চালাচ্ছে। মামলা মোকদ্দমা দিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করে চলেছে। এমনকি প্রকাশ্যে গুলি করার মতো জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না।
বেসরকারি একটি হিসাবে জানা গেছে, গত ২৬ নভেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক মাসে সারাদেশে রাজনৈতিক কারণে নিহত হয়েছে অন্তত ১২০ জন। নিহত এসব মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মীর বাইরেও অনেক সাধারণ মানুষ রয়েছে।
অতীতে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশে কার্যরত জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকলেও সম্প্রতি এসব সংস্থার তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। নির্বিচারে এসব মানুষ হত্যার প্রতিবাদে কোনো বিবৃতি বা বক্তব্যও দিতে দেখা যাচ্ছে না এসব সংস্থাকে।
সম্প্রতি রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় বিরাজমান সংকট থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধ করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এমন একটি পন্থা বের করার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দেশে শান্তি তো আসবেই না, বরং দীর্ঘ মেয়াদের জন্য অশান্তি আরো প্রকট আকার ধারণ করবে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
এ বিষয়ে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা গণতন্ত্র নামটা পেয়েছি। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র পাইনি। অনির্বাচিত স্বৈরাচার বিদায় করা যতটা সহজ, নির্বাচিত স্বৈরাচারকে ততটা সহজে বিদায় করা যায় না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে নির্বাচন বন্ধ করার দাবিতে বিরোধীদলীয় নেতা সারা দেশের মানুষকে রাজধানীতে জমায়েত হতে গত ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। ৫ জানুয়ারি একদলীয় নির্বাচনকে ‘না’ বলতে এবং গণতন্ত্র, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনকে ‘হ্যা’ বলতে এই সমাবেশের আহ্বান করেন তিনি। কিন্তু সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় এবং পথে পথে বাধা সৃষ্টি করায় ২৯ ডিসেম্বর সেই কর্মসূচি পালন করতে পারেনি বিরোধী জোট।
এছাড়া বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে তার গুলশানের বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারের এ বাকশালী আচরণের প্রতিবাদে ও নির্বাচন বন্ধের দাবিতে বেগম খালেদা জিয়া ১ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা করেন।
এদিকে নির্বাচনের আগেই সারাদেশের ৩০০ টি নির্বাচনী আসনের মধ্যে ১৫৪ টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ফলে দেশের মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ভোটারের মধ্যে ৪ কোটি ৮৩ লাখ ভোটারের ভোট দেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়েনি। এ হিসাবে দেশের শতভাগ ভোটারের মধ্যে ৫২ শতাংশ ভোটার তাদের মতামত প্রদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এসব কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ নিয়েও কোনো ধরনের মাথা ঘামাচ্ছে না সরকার। সরকার দলীয় নেতারা বলছেন, বিদেশী পর্যবেক্ষক ছাড়াই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তাই সার্বিক বিবেচনায় ‘কী হবে আগামী ৫ জানুয়ারি’ এ নিয়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে দেশের আপামর জনসাধারণ।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট কাজী সিরাজ প্রাইমনিউজ.কম.বিডিকে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সম্ভাব্য সহিংসতার বিষয়ে খোদ সরকার দলীয় নেতারাই উদ্বিগ্ন। তাদের এ উদ্বেগের কথা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে বলেও বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা খবর পেয়েছি। যদি সরকার বিতর্কিত এই নির্বাচনটি করেও ফেলে তাহলে নির্বাচন পরবর্তী সময়গুলোও দেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর হবে বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান মিয়া প্রাইমনিউজ.কম.বিডিকে জানান, এক পাক্ষিক কোনো কিছুই দেশ ও মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা সারা দেশের মানুষের অন্যতম চাওয়া। কিন্তু ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় বিরোধী দলের অংশগ্রহণবিহীন এ নির্বাচন নিয়ে আমাদের মনেও নানা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিরোধী জোটের এ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণার কারণে ওই দিন সংঘাত, সহিংসতার আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মনে করেন তিনি।