দুটি ছবি দেখে লজ্জিত হয়েছি জাতি হিসেবে। দু’জন নারী আইনজীবী ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৩ বিরোধী ঘোষিত গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার কর্মসুচিতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন। এই ছবিতে পরিষ্কারভাবে অশালীনভাবে নারীর প্রতি অবমাননার যে দৃশ্য ফুটে উঠেছে তা দেখে আমাদের নারী আন্দোলনের কর্মীদের আর চুপ করে থাকা চলে না।
হয়তো আমাদের নিশ্চুপভাবে মেনে নেয়াই ক্রমাগতভাবে এই ধরনের নির্যাতনকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা ও মতের পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু কোনো নারীকে মাটিতে ফেলে পুরুষ পুলিশ কিংবা দলীয় ক্যাডার বাহিনী বেধড়ক পেটাবে এবং তাদের প্রকাশ্যে অপমান করবে এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
এই ঘটনা এরই মধ্যে আরো ঘটেছে। ভিন্ন কারণে এবং ভিন্ন পরিস্থিতিতে। কিন্তু মানসিকতা একই। নারীদের রাস্তার আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতেই তাদের ওপর চড়াও হওয়া পুরুষতান্ত্রিক বিকৃতি। কিছুদিন আগে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন নারীকর্মী পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন । তাদের সাথে নির্মম ও অশ্লীল আচরণ করা হয়েছে। কিন্তু সে সময়ও নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে জোরালো কোনো প্রতিবাদ দেখিনি। কেন, আমি জানি না। টেলিভিশনে দুএকটি টকশোতে বিষয়টি হাল্কাভাবে তুলে ধরা ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। তারও আগে হেফাজতের কর্মসূচিতে এক নারী সাংবাদিকের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে তা নিয়ে নারী আন্দোলনের তরফে ঐক্যবদ্ধ ভাবে খুব একটা উচ্চবাচ্য কেউ করেনি।
এসব ঘটনার পক্ষ-বিপক্ষ ভিন্ন। যারা নারীর ওপর আক্রমণ করছে তারা যদি সরকার দলের হয় আর যে মার খাচ্ছে সে যদি বিরোধী দলের হয় তাহলে নারী আন্দোলনের মধ্যে যারা সরকার পক্ষের আছেন, তারা নারী হিসেবে মেনে নিতে না পারলে্ও চুপ করে থাকছেন। অন্যদিকে যারা সরকারের বিপক্ষে আছে এবং নারীরা বিরোধী পক্ষ দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে তারাও চুপ হয়ে আছেন, কারণ যারা নির্যাতিত হচ্ছেন তারা তাদের জন্যে ‘অপর পক্ষ’। এইভাবে আমরা সবাই মিলে সামগ্রিকভাবে নারীদের বিপক্ষ দলকেই শক্তিশালী করছি।
শুধু তাই নয়, আমি যদি এখন ২৯ ডিসেম্বরের ঘটনায় নির্যাতিত নারীদের পক্ষে বলতে যাই হয়তো আমি চিহ্নিত হবো একটি বিশেষ দলের সমর্থক হিসেবে, এবং সে কারণে এই বিষয়ে আমি কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকতে পারতাম। কিন্তু আমরা চুপ থাকলেই যে দেশের ভাবমুর্তি রক্ষা হচ্ছে তা নয়।
বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক সহিংসতার কথা দেশের পত্রিকায় যেমন ছাপা হচ্ছে তেমনি বিদেশী পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে খবর হিসেবে কিন্তু ছবি যাচ্ছে একজন নারী আইনজীবীকে দলীয় ক্যাডাররা লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে, আর সে নারী ফুটপাতে শুয়ে আছে। দেখুন Political Clashes Grow in Bangladesh’s Capital (NYTimes.com.htm) The New York Times, JULFIKAR ALI MANIK and GARDINER HARRIS Published: December 29, 2013 ছবির শিরোনাম “Supporters of the governing Awami League beat a supporter of the Bangladesh Nationalist Party at a protest in Dhaka on Sunday।
লক্ষ করার বিষয় যে শিরোনামে কোথাও নারীর ওপর নির্যাতনের কথা নেই, আছে এক দলের সমর্থকরা অন্য দলের সমর্থকদের পেটাচ্ছে। কিন্তু শিরোনাম দিয়ে না লিখেও ছবির মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে এটা কেবল দুটি দলের মধ্যে পেটানোর বিষয় নয়, এটা একই সাথে নারীর ওপর পুরুষতান্ত্রিক নগ্ন হামলা। এই ধরণের পাশবিক হামলার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত গার্মেন্ট আন্দোলনের নারী কর্মীরাও। কিন্তু শ্রমিক মেয়েদের পক্ষে কথা বলার জন্য নারী আন্দোলন সোচ্চার নয়। ভাবখানা এরকম যে নারী শ্রমকদের বিষয় একান্তই শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপার, ওর সঙ্গে যেন নারী আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই।
শুধু একটি ঘটনাই নয়। সেদিন আরো একজন নারী আইনজীবীর ওপর চড়াও হয়েছে সরাকারি দলের ক্যাডাররা। তারা যেভাবে ইচ্ছে মতো সেই নারীকে পেটাচ্ছে, এই দৃশ্য শ্লীলতাহানীর পর্যায়ে পড়ে। ছবিতে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে তাকে লাথি মারা হচ্ছে। কালের কণ্ঠসহ কয়েকটি পত্রিকায় যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে তা দেখলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। । কালের কণ্ঠের শিরোনাম “গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্টে বিক্ষোভরত জাতীয়তাবাদী আইনজীবীদের ওপর আওয়ামী লীগ কর্মীরা হামলা চালায়। তাদের পিটুনিতে আহত হন অ্যাডভোকেট সিমকী ইমাম খান” (৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩)।
অন্য একটি সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি একজন সাংবাদিক তাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে নিজের বোনের মতো করে রক্ষা করেছেন।আমি ধন্যবাদ জানাই সেই সাংবাদিককে যিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি তার মানবিক দায়িত্ব পালনের কথা ভোলেননি।এই ঘটনায় আমরা পাশবিক উত্তেজনার পুরুষ নামক কিছু দানবকে দেখেছি একই সাথে আমাদের সংস্কৃতিতে ভাই হিশেবে বোনকে রক্ষা করার মানসিকতাও দেখেছি। ঠিক যেমন পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিনের ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদ করেছিল দিনাজপুরে সাত জন প্রাণ দিয়েছিল।
আমি খুব অবাক হয়ে যাচ্ছি, পত্রিকায় এতো পরিস্কারভাবে ছবি দেয়া সত্ত্বেও কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যাবস্থা নেয়া হচ্ছে না। শুধু টিভি টক শোতে কিছু নিন্দা জানানো ছাড়া আর কিছুই হয় নি। ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ সময় টিভির টক শোতে নিন্দা জানিয়েছেন। তাকে ধন্যবাদ।
আমরা এভাবে আর কত দিন নিজেদের নিষ্ক্রিয় রাখবো? আমাদের দেখার বিষয় কি কেবলি কে আক্রমণ করছে এবং কে আক্রান্ত হচ্ছে? সেই মোতাবেক আমরা প্রতিক্রিয়া জানাবো? নাকি নারীর প্রতি এই অশ্লীল সহিংসতা বন্ধের জন্য দল মত নির্বিশেষে এক হয়ে কাজ করব? আমাদের মধ্যে বিভাজন পুরুষতন্ত্রকেই শক্তিশালী করবে আর নারী নিগ্রহের শিকার হতে থাকবে।
আসুন সবাই মিলে দাবি তুলি, বন্ধ করো নারীর ওপর পৈশাচিক আক্রমণ।