মানবাধিকারের চরম অস্থিতিশীল অবস্থা অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে দেশে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উত্থান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে দেশে ঢালাও অভিযান শুরু হয়েছে। এতে নিরপরাধ লোকজনকে গ্রেফতার করছে আইন-শৃংখলা বাহিনী। আবার অনেক সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যদের ধরে শিবিরকর্মী বানিয়ে ফেলছে পুলিশ। মঙ্গলবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির হলরুমে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসাক)। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি-২০১৩ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটির কর্মকর্তারা এসব বলেছেন। আসকা-এর পরিসংখ্যানে জানানো হয়, এক বছরে সারা দেশে ৫৩ জন গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছে। রাজনৈতিক সংঘাতে ৫০৭ জন নিহত, ৭২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাসীদের হামলায় ৩ সাংবাদিক নিহত ও ২৮০ জন আহত, সীমান্তে ২৬ জনকে হত্যা ও ৮১২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান, সিনিয়র উপপরিচালক মোঃ টিপু সুলতান, সিনিয়র কর্মকর্তা আবু আহমেদ ফজলুল করিম, সিনিয়র উপপরিচালক নীনা গোস্বামী ও সিনিয়র উপপরিচালক সানাইয়া ফাহিমা আনসারী প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আসকের সভাপতি আবু আহমেদ ফজলুল করিম।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল চরম উদ্বেগজনক। বছরব্যাপী ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা রাজনৈতিক সহিংসতা ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন যানবাহনে পেট্রল বোমা ছোড়ার কারণে এবং বোমা বানাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে দেশের সাতটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৯৭ জনের মধ্যে ২৫ জন মারা যান। এ বছর বিভিন্ন সময় সহিংসতার খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্ন পক্ষের রোষানলে পড়ে তিনজন সাংবাদিক মারা গেছেন। দেশে গুম ও গুপ্তহত্যা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নতুন সংযোজন। ২০১৩ সালে হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার নামে আইন-শৃংখলা বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ৭২ জন। এছাড়া এ বছর ৮১২ জন গণধর্ষণ, সীমান্তে হত্যা ৩৬৫ জন এবং ক্রসফায়ারের নামে গণহত্যাও চালানো হয়। অপরদিকে বিশ্বজিৎ হত্যার রায়ে ছাত্রলীগের আটজনের মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। ২০১৩ সালের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনায় দেখা যায়- মানবাধিকারের প্রধান দুই ভাগের মধ্যে একটিতে; অর্থাৎ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এ বছরে ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বাপেক্ষা ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে প্রভাবশালী গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট (ইফপ্রি) বিশ্বের ক্ষুধা সূচক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে। এ বছরে সূচকে ১১ ধাপে এগিয়েছে বাংলাদেশ। একই সময়ে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তাদের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক বৈশ্বিক আস্থা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে খাদ্য নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছে। এছাড়া শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যুর হার ও দারিদ্র্য হ্রাস পাওয়াসহ মানব উন্নয়ন সূচকের অনেকগুলো অর্জন বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত করেছে। এ বছরে সবচেয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা যায় ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিশেষ অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। যুদ্ধাপরাধের বিচারে ৬টি রায় দেয়া হয়। সরকার কর্তৃক দেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের আলোকে ‘শিশু আইন-২০১৩’ প্রণয়ন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০১৩, জাতীয় নদী রক্ষা আইন-২০১৩ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
গুম-গুপ্তহত্যা : প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নতুন অপেক্ষাকৃত নতুন সংযোজন গুম বা গুপ্তহত্যা। অপহরণ, নিখোঁজ, গুম বা গুপ্তহত্যার প্রায় সব ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন জোরপূর্বক কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর কয়েকদিন ধরে তিনি নিখোঁজ থাকেন এবং এরপর কোনো একদিন হঠাৎ করে কারও গলিত পচা লাশ উদ্ধার হয়। আবার দীর্ঘদিন ধরে কোনো প্রকার খোঁজই মেলে না। অধিকাংশ ঘটনায় অপহৃত, নিখোঁজ বা নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষত র্যাব ও ডিবির বিরুদ্ধে এসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুললেও সাধারণত এ ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে কোনো প্রেস নোট প্রদান বা কোনো প্রকার দায়-দায়িত্ব স্বীকারসহ গুম বা গুপ্তহত্যা রোধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা কিংবা তদন্ত কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয় না। ২০১৩ সালে এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন। তার মধ্যে ৫ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৩ জনকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে, মাত্র ২ জন মুক্তি পেয়েছেন এবং বাকিদের খোঁজ এখনও মেলেনি।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু : বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হলেও সরকারের শেষ বছরে এসেও আইন-শৃংখলা বাহিনীর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময় ও এনকাউন্টারের নামে রাষ্ট্রীয় মোড়কে হত্যাকাণ্ড এবং থানা-পুলিশসহ বিভিন্ন হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা অব্যাহত ছিল। ২০১৩ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৭১ জন। তার মধ্যে র্যাবের ক্রসফায়ারে ২৪ জন, পুলিশের ক্রসফায়ারে ১৭ জন, বিজিবির ক্রসফায়ারে ১ জন এবং পুলিশ হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে ২৬ জন, র্যাব ও পুলিশের শারীরিক নির্যাতনে ১ জনের মৃত্যু হয়।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি : ২০১৩ সালে দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি ছিল খুবই উদ্বেগজনক। এ বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় ও জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিরোধকে কেন্দ করে বিভিন্ন সহিংস কর্মকাণ্ড ও নাশকতার ঘটনা ঘটে। প্রতিবেদনে কলা হয়, ১৮ দলীয় জোটের ডাকা লাগাতার হরতাল-অবরোধের সময় জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা বিশেষত ককটেল ও বোমা বিস্ফোরণ, পেট্রল বোমা নিক্ষেপ এবং ভাংচুর, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চরম আকার ধারণ করে। অপরদিকে বিরোধী দলের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি মোকাবেলায় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে গ্রেফতার, আটক, গুলিবর্ষণসহ অতিমাত্রায় বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটে। বিএনপির কার্যালয়ে হামলা ও ভেতরে ঢুকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ ১৪৫ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃংখলা বাহিনী কর্তৃক বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা দান, জামায়াত-শিবিরের ঝটিকা মিছিলে গুলি, গণগ্রেফতার ও আটকের ঘটনা রাজনৈতিক সহিংসতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আইন-শৃংখলা বাহিনীর সংঘর্ষ, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিরোধী দল এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ মোট ৮৪০টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব রাজনৈতিক সংঘাতে মোট ৫০৫ জন নিহত এবং প্রায় ২২ হাজার ৩৬৭ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে ১৫ জন পুলিশ সদস্য ও দুজন বিজিবি সদস্য রয়েছেন। ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ডাকে ঢাকা অবরোধ এবং পরে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশকে ঘিরে ওইদিন দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ ও সহিংসতায় একজন পুলিশসহ ২২ জন নিহত হয় বলে পত্রপত্রিকা সূত্রে জানা যায়। এ বছরে অবরোধকারীদের অন্যতম টার্গেট ছিল ট্রেনে নাশকতা। দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রেনের বগিতে আগুন, ফিসপ্লেট খুলে ফেলা ও লাইন উপড়ে ফেলাসহ ট্রেনে নাশকতার অনেক ঘটনা ঘটে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন : ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায়কে কেন্দ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু নির্যাতন; বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়, বাড়িঘর, দোকানপাটে আগুন দেয়া এবং প্রতিমা ভাংচুরসহ লুটপাট, চাঁদাবাজি, শারীরিক নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটে। যার অধিকাংশ ঘটেছে ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী ও জামায়াত-শিবিরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মদদে। আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার ব্যাপারে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট দায়িত্বশীল পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের আশঙ্কার বিষয়ে আগে থেকেই আঁচ করা গেলেও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ আগাম সতর্কতা হিসেবে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে হামলাকারীরা নির্বিঘ্নে এত সহিংস ঘটনা ঘটাতে পেরেছে। এই বছরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৭৮টি বাড়িঘরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, ২০৮টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর এবং মন্দির-উপাসনালয় ও প্রতিমা ভাংচুরের ৪৯৫টি ঘটনা ঘটে। এছাড়া সংখ্যালঘু আহমদিয়া মুসলিম জামায়াতের ওপরও হামলা-নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটে।
সাংবাদিক নির্যাতন : ২০১৩ সালের রাজনৈতিক সহিংসতার অন্যতম শিকার হন গণমাধ্যমের কর্মীরা। বিভিন্ন সময় খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা রাজনৈতিক দলগুলোর রোষানলে পড়েন এবং হত্যা, নির্যাতন ও গ্রেফতারসহ বিভিন্ন হয়রানির শিকার হন। গত বছরের বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বারবার প্রতিশ্র“তি দেয়ার পরও মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ নিয়ে সাংবাদিক সমাজ বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংবাদিক নির্যাতনের ওপর প্রকাশিত খবরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ বছরে ৩ জন সাংবাদিক নিহত হন এবং অন্তত ২৮০ জন সংবাদকর্মী বিভিন্নভাবে বিভিন্নজনের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন। তার মধ্যে ৪৩ জন আইন-শৃংখলা বাহিনীর দ্বারা, ৫৬ জন সন্ত্রাসী দ্বারা, ১৪১ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের দ্বারা এবং হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক ২৪ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হন। ৫ মে রাজধানীর পল্টনে পুলিশ ও হেফাজতে ইসলামের মধ্যে সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে আহত সাংবাদিক ফারহান পরবর্তীকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। ২১ নভেম্বর রাতে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া বাজারে কুপিয়ে হত্যা করা হয় দৈনিক জন্মভূমির দেবহাটা উপজেলা প্রতিনিধি আবু রায়হানকে।
নারী নির্যাতন : বিগত বছরগুলোর মতো ২০১৩ সালেও নারী উত্ত্যক্তকরণ, সালিশের নামে ফতোয়া, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন ও গৃহকর্মী নির্যাতনসহ নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটে। দেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অব্যাহত আন্দোলনের কারণে নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা হলেও মূলত বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার ফলে ঘটনার সংখ্যা ও ভয়াবহতা কমছে না।
ধর্ষণ : ২০১৩-এর শুরুর দিকে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ও এর ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হয় এবং এ বিষয়ে দেশব্যাপী নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবাদসহ বিভিন্ন আন্দোলন-কর্মসূচি অব্যাহত থাকে। ২০১৩ সালে মোট ৮১১ জন নারী ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী সময়ে ৮৬ জনকে হত্যা করা হয় এবং আÍহত্যা করেন ১৪ জন।
উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি ও নির্যাতন : বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মস্থলে যৌন নিপীড়ন ও বখাটেদের দ্বারা নারী উত্ত্যক্তকরণের ঘটনা ঘটেছে। এ বছর সবচেয়ে আলোচিত হয় কুষ্টিয়ার স্কুল শিক্ষক হেলাল উদ্দিন ও তার সহযোগীদের দ্বারা এলাকার স্কুল ছাত্রীসহ কয়েকজন নারীর সঙ্গে ফুসলিয়ে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং তাদের মেলামেশার দৃশ্যগুলো ভিডিও ধারণ করে পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা।
সালিশ ও ফতোয়া : ফতোয়ার নামে বিচারবহির্ভূত শাস্তি প্রদান অসাংবিধানিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বলে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বিগত বছরের মতো ২০১৩ সালেও ফতোয়া ও সালিশের মাধ্যমে নির্যাতিত হয়েছেন অনেক নারী। ২০১৩ সালে সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ২১ জন নির্যাতনের শিকার হন।
এসিড নিক্ষেপ, পারিবারিক নির্যাতন এবং গৃহকর্মী নির্যাতন : বিগত বছরের মতো ২০১৩ সালেও নারীর ওপর এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন এবং গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের ঘটনা অব্যাহত ছিল। এসিড নিক্ষেপের শিকার হন ৪৪ জন নারী, যার মাত্র ১৬টি ঘটনায় থানায় মামলা হয়।
সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন : ভারতের সীমান্ত প্রহরী বিএসএফের গুলিতে ২০১৩ সালে নিহত হয়েছেন অনেক নিরীহ নাগরিক। এই বছর সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতনসহ ৩৩৫টি ঘটনা ঘটে। তার মধ্যে হত্যার শিকার ২৬ জন, শারীরিক নির্যাতনে আহত ৮৪ জন এবং অপহরণের শিকার ১৭৫ জন।
অধিকার : মত প্রকাশের অধিকার সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হলেও এ বছরের বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলগুলোর সভা-সমাবেশে বাধা দান এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকের স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশের অভিযোগে ১১ এপ্রিল আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। ৫ মে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের সরাসরি সম্প্রচারের সময় দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি নামে দুটি বেসরকারি টেলিভিশনের সম্প্রচার পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের সবচেয়ে বিপর্যয়কর ঘটনা ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে ৬টি গার্মেন্ট কারখানার ১১৩৪ শ্রমিকের মৃত্যু, ওই ঘটনায় প্রায় আড়াই হাজার আহত হয়। বাসস্থানের অধিকার সংবিধানের অন্যতম মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত হলেও ২০১৩ সালে কোনোরকম নোটিশ ও পুনর্বাসন ছাড়াই অনেক বস্তি ও বাসস্থান উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। ১৭ অক্টোবর হাজারীবাগ বালুর মাঠ বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে ৪৭৫টি ঘর পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়।
ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি থাকা সত্ত্বেও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এখনও মেলেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও কার্যত থেমে আছে এবং পার্বত্য ভূমি কমিশনের কার্যক্রমও গতিশীল হচ্ছে না।