পদোন্নতিবঞ্চনা আর ওএসডির অসন্তোষে অস্থির প্রশাসন

0
94
Print Friendly, PDF & Email

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে জনপ্রশাসনে পদোন্নতিবঞ্চনাজনিত ক্ষোভ-অসন্তোষই ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। যতবার পদোন্নতি দেয়া হয়েছে ততবারই এই ক্ষোভ অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে ছিল বেশ কিছু অফিসারকে দীর্ঘদিন ওএসডি করে কাজের বাইরে ফেলে রাখার অসন্তোষ। আর গত মে-জুন মাসে কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের ঘটনাও একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে মহাজোট সরকারের আমলনামায় স্থান করে নিয়েছে। বিগত বিএনপি সরকারের (২০০১-২০০৬) মতো এ সরকার অবশ্য ঢালাওভাবে বেশি সংখ্যায় বাধ্যতামূলক অবসর দেয়নি। তবে এ রকম একটি শংকার খবর সামনে অপেক্ষা করছে বলেও অনেকে বিচলিত হয়ে পড়েছেন।
জানা গেছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছর (২০০১-২০০৬) জুড়েই ছিল দফায় দফায় মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশকে পদোন্নতি না দেয়ার তীব্র অভিযোগ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল চাকরিচ্যুতি, ওএসডি করে ফেলে রাখা এবং দলীয় বিবেচনায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাওয়া। সে সময় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রশাসনে এসব অন্যায়, জুলুমের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। যদিও বিএনপি আমলের বেশ কিছু ক্ষত ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দু’বছর মেয়াদি ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় অনেকখানি নিরাময় করে তোলা হয়। বাকিটা ছিল পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য। আওয়ামী লীগও নির্বাচনী ইশতেহারে বেশ হাঁকডাক দিয়ে বলেছিল, তারা একটি নির্দলীয় ও মেধাভিত্তিক প্রশাসন গড়ে তুলবে। মূল্যায়ন করা হবে প্রকৃত মেধা ও যোগ্যতার। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ এসব প্রতিশ্র“তি ভুলে যায়। তারা বিএনপির দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করে। নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দলীয়করণের বাইরে কিছুই করা হয়নি। বেছে বেছে তারা নিজেদের দলপন্থী ও দলপন্থী দাবিদার (সুবিধাবাদী) কর্মকর্তাদের প্রাইজ পোস্টিং দিয়েছে। আর তাদের পদোন্নতি হয়েছে নির্বিঘ্নে। বিপরীতে সরকারি দলের প্রতিপক্ষ বিবেচনায় বাদ পড়েছেন বহু নিরপেক্ষ ও নিরীহ ধাঁচের সাধারণ কর্মকর্তা। আবার রহস্যজনক কারণে ক্ষেত্রবিশেষে বিএনপি ও জামায়াত ঘরানার চিহ্নিত কর্মকর্তাকেও পদোন্নতি দিতে দেখা গেছে।
মহাজোট সরকারের সময়ে প্রথম পদোন্নতি হয় ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি সচিব পদে এবং সব শেষ পদোন্নতি হয়েছে ১০ সেপ্টেম্বর যুগ্মসচিব পদে। এ নিয়ে উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত চার স্তরে ১৯ দফায় দুই হাজারের বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সংবাদ বিশ্লেষণের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, এ সময় বঞ্চিত হয়েছেন প্রায় সমসংখ্যক কর্মকর্তা। তবে এসএসবি (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) কিংবা সরকারের নীতিনির্ধারক মহল কখনোই পদোন্নতিবঞ্চনার অভিযোগ স্বীকার করেননি। বরং জোরা দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো কারণ ছাড়া কাউকে পদোন্নতি থেকে বাদ দেয়া হয়নি। অবশ্য এমন চিত্রও দেখা গেছে, কিছু কিছু কর্মকর্তাকে দু-একবার পদোন্নতি না দিয়ে পরবর্তীকালে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে ছয় মাস কিংবা এক বছরের ব্যবধানে এসব কর্মকর্তা কীভাবে অযোগ্য থেকে যোগ্য হয়ে গেলেন তা অনেকের কাছে বোধগম্য হয়নি। আবার কিছু কর্মকর্তা এভাবে বিলম্বে পদোন্নতি পেলেও এখনও তারা ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা ফিরে পাননি। ওদিকে সরকারের শেষদিকে এসে গত নভেম্বরে উপসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি বিবেচনার জন্য এসএসবি পদোন্নতির সুপারিশ চূড়ান্ত করলেও তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়নি।
সূত্র জানিয়েছে, উপসচিব পদে (লেফট-আউটসহ ২০তম ব্যাচ) পদোন্নতির সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পড়ে আছে। আর অতিরিক্ত সচিব পদে (লেফট-আউটসহ ৮৪ ব্যাচের অবশিষ্ট যুগ্মসচিব) পদোন্নতির সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করার পর তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সম্মত না হওয়ায় এ দুটি ধাপে পদোন্নতি আর হয়নি। এছাড়া যুগ্মসচিব পদে যারা একাধিক দফায় বঞ্চিত হয়েছেন তাদের মধ্যে সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু কর্মকর্তার নাম বাদ পড়ায় তারাও পদোন্নতি পাওয়ার জন্য এক রকম মুখিয়ে আছেন। তাদের সাফ কথা, যুগ্মসচিব পদে আগে তাদের পদোন্নতি না দেয়া পর্যন্ত অন্য কোনো ধাপে পদোন্নতি দেয়া যাবে না। সূত্র জানিয়েছে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন সম্পন্ন হলে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে আটকে থাকা এসব পদোন্নতির জট দ্রুত খুলতে শুরু করবে।
এদিকে প্রশাসনে গতকাল পর্যন্ত ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা ৮০১ জন। এর মধ্যে সচিব পদে ৬ জন, অতিরিক্ত সচিব ৪০ জন, যুগ্মসচিব ৩৩০ জন, উপসচিব ৩২০ জন এবং অবশিষ্ট শতাধিক কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব। এসব ওএসডি কর্মকর্তার মধ্যে রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন ওএসডি রয়েছেন এ রকম কর্মকর্তার সংখ্যা দেড় শতাধিক। যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব ২০০৯ সাল থেকে ৭ বছর ধরে ওএসডি আছেন। দীর্ঘদিন ওএসডি ও পদোন্নতিবঞ্চিত থাকা কর্মকর্তারা সম্প্রতি কয়েক দফায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎ করতে গিয়ে সচিবালয়ের মধ্যে ক্যাডার কর্মকর্তারা বড় ধরনের শোডাউনও করেন। সবশেষ ৮ ডিসেম্বর শোডাউনের সময় সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে ব্যাপক নজরদারি করাসহ সমবেত হওয়া কর্মকর্তাদের ছবি সংগ্রহ করা হয়। ভিডিও ফুটেজ ও স্টিল ক্যামেরার ছবি থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কর্মকর্তাদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
পদোন্নতিবঞ্চিত ও দীর্ঘদিন ওএসডি থাকা কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, তারা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছেন ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর তাদের বহু কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। বিশেষ করে যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের সবাইকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হবে। বাকিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করাসহ শাস্তিমূলক বদলি কিংবা মাঠ প্রশাসনে সংযুক্তি প্রদান করা হতে পারে। এছাড়া নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা সচিবালয়ের মধ্যে প্রকাশ্যে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছেন তাদেরও বাড়ি পাঠানো ব্যবস্থা করা হবে। ইতিমধ্যে এ ধরনের একটি গোপন তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে তারা মনে করেন, সরকার সত্যিই যদি এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে এবং বাস্তবায়ন করে তাহলে প্রশাসন আরও উত্তপ্ত হবে। সচিবালয়ের এ ক্ষোভ অসন্তোষ মাঠ প্রশাসনেও ছড়িয়ে পড়বে।
এদিকে মহাজোট সরকারের গত পাঁচ বছরে প্রশাসন সংস্কার বলতে মৌলিক কিছু তেমন করা হয়নি। শুধু সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে দু’বছর আগে ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতিসহ প্রশাসন পরিচালনার জন্য একটি আইন প্রণয়নের খসড়া কয়েক দফায় চূড়ান্ত করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। বিশেষ প্রয়োজনে শূন্য পদের বাইরে পদোন্নতি দিতে গিয়ে উল্টো জনপ্রশাসন এখন অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। একই পদে কয়েক ব্যাচের অফিসার থাকায় চেইন অব কমান্ড রক্ষা করা নিয়ে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। ওদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেয়া হলেও প্রশাসনে এর তেমন কোনো ছায়া পড়েনি। কিছু জেলায় সেবা দেয়ার জন্য সীমিত পরিসরে ই-সার্ভিস চালু হলেও অফিসপাড়ায় এখনও ই-ফাইলের কাজ শুরু করা যায়নি।
জনপ্রশাসনের মতো পুলিশ প্রশাসনেও তেমন কোনো সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। কাজের মধ্যে পুলিশের কিছু পদ-পদবি আর সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। পুলিশে চাকরিচ্যুত হয়েছেন ৪ জন কর্মকর্তা। আর ওএসডি ছিলেন ২০ জন। অবশ্য এ সংখ্যা এখন কিছুটা কমে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশে নিয়োগ, বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে দলীয়করণের অভিযোগ প্রকট আকার ধারণ করেছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকার নির্বাচনকালীন সরকার হলেও এতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কোনো সদস্য যোগ না দেয়ায় এটি এখনও সাধারণ মানুষের কাছে মহাজোট সরকার হিসেবেই পরিচিতি পাচ্ছে। এছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আগেও ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এখনও তিনিই রয়েছেন। এ বিবেচনায় মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরের প্রশাসন কেমন ছিল তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

শেয়ার করুন