মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বললেন-
যেসব ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ সরকারকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ১/১১-এর কুশীলবরা আবারও সক্রিয় হয়েছে। গণমাধ্যমে সংবাদটি বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। রোববার সকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গণভবনে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার ফল গ্রহণকালে এ কথা বলেন। বিশিষ্ট নাগরিকদের কঠোরভাবে সমালোচনা করে তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচন একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়ার পর বিশিষ্ট নাগরিকরা তা বন্ধ করতে চান। তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষ বিশেষ করে ২০০৭-০৮ সালে বিশিষ্ট নাগরিকদের সরকারের শাসন দেখেছে, তারা দেশ ও জনগণের জন্য কিছুই করেননি। বিশিষ্টজনরা এখন বিএনপির মদদে আরেকটি ১/১১-এর পরিকল্পনা করছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সঙ্গে ‘সঙ্কটে বাংলাদেশ, নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক ওই আলোচনা অনুষ্ঠানে সহ-আয়োজক ছিল আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এতে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ প্রশস্ত করতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিতের পরামর্শ দেয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সিপিডির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. রেহমান সোবহান।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বর্ণিত সভার বিভিন্নজনের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, ওই আলোচনায় নির্বাচন পেছানোর যে দাবি জানানো হয়েছে তা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও শিষ্টাচারবহির্ভূত। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আরও দাবি করেন, নির্বাচন পেছানোর দাবির পেছনে মূলত একটি নির্দিষ্ট দলের সমর্থনকারীরাই অংশ নিয়ে নির্বাচন পেছানোর মতামত দিয়েছেন। অবশ্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য ঠিক নয় বলে দাবি করেছে সিপিডি।
শনিবার ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন দেশের ২৫০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। এ বিশিষ্টজনের মধ্যে প্রায় ৬০ জন আলোচনায় অংশ নেন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেনÑ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ড. মঞ্জুর এলাহী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, মাহফুজ আনাম, শমশের মবিন চৌধুরী, ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, তপন চৌধুরী, সৈয়দ আবুল মকসুদ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন চৌধুরী, মতিউর রহমান চৌধুরী, ড. পিয়াস করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, আনিসুল হক প্রমুখ। আলোচনা অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা অংশ নেননি বলে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান।
বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বা সরকারি দল স্বীকার না করলেও সচেতন মহল সবাই একমত যে দেশে এখন প্রকট রাজনৈতিক সঙ্কট বিরাজমান। সঙ্কট নিরসনে দেশের বিশিষ্টজনরা ছাড়াও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার সুফল এখনও পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা এমনকি জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো গৃহীত পদক্ষেপও গুরুত্ব সহকারে নেয়া হয়নি। ফলে দেশ গভীর অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ জনগণ এখন অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত। দেশের বুদ্ধিজীবী মহল, ব্যবসায়ী মহল এবং বিশিষ্টজন, যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তারা সবাই এখন অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যেন অনিশ্চয়তা ও অশনিসঙ্কেতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদেরও অনেক উৎকণ্ঠা রয়েছে, আমি নিজে ৩০ নভেম্বর ২০১৩ দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সমীপে সমস্যা সমাধানের জন্য আবেদন জানিয়েছিলাম।
জাতীয় যে কোনো সঙ্কট মুহূর্তে সবকিছু নিজেদের ওপর ভরসা না রেখে যাদের ওপর বিশ্বাস আছে এমন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বা চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা হলে তাতে কোনো ধরনের আত্মশ্লাঘা না হওয়ারই কথা। সরকারে যারা আছেন তাদের যোগ্যতা অথবা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তারপরও বাংলাদেশের নেতৃত্ব এ বিপদের সময় নিজেদের বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে নতুন পথ সম্পর্কে দিকনির্দেশনার ব্যাপারে আলোচনা করতে তো বাধা নেই। এতে আর কিছু না হোক কোনো ক্ষতির কারণ তো নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে যারা কথা বলছেন বা যারা প্রতিনিয়ত মিডিয়াতে কথা বলছেনÑ তাদের আলোচনা, দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক হচ্ছে কিনা তাও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
সিপিডি কর্তৃক আয়োজিত ওপরে বর্ণিত ‘সঙ্কটে বাংলাদেশ, নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্টজনদের কারও কারও সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রিজার্ভেশন থাকতেই পারে। এসব বিশিষ্টজনের মধ্যে সবাই যে নিরপেক্ষ নন বা তারা একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বলার যুক্তি আছে কি? তারপরও বলতে হয়, সংশ্লিষ্ট সব বুদ্ধিজীবীর ওপরই যদি বর্তমান নেতৃত্বের অবিশ্বাস থেকে থাকে, তাহলে যাদের তিনি বা তার সরকার নিরপেক্ষ মনে করেন, যাদের ওপর তাদের আস্থা রয়েছে, তাদের কাছ থেকেও না হয় পরামর্শ নেয়া হোক। দেশের এই সঙ্কটকালে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তারা কোনো খারাপ পরামর্শ দেবেন না। প্রধানমন্ত্রী চাইলে কি এই উদ্যোগ নিতে পারেন না?
দেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে বলা যায়, আমরা এখন একেবারে খাদের কিনারে পৌঁছে গেছি। সময়ক্ষেপণের আর কোনো সুযোগ নেই। এখন খোলা মনে, দেশের কথা বিবেচনা করে যে কারও ভালো পরামর্শকে আমলে নিতে হবে। গোটা জাতি এখন এই দুঃসহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়। যে কোনো সুপরামর্শ দলীয় বা ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে না দেখে, সব কিছুকে নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার মানসিকতা এখন পরিহার করতে হবে। এটা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। হ্যাঁ, এ কথা সত্যি, পরামর্শ গ্রহণ করা না করা এটা যার যার নিজস্ব এখতিয়ার, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির দাবি সেটা নয়। নিজস্ব বক্তব্য ও চিন্তা আঁকড়ে ধরে বসে থাকলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এ ধরনের অবস্থান থেকে নতুন কিছু আর আশাও করা যায় নাÑ এটা এখন স্পষ্ট।
আমার এ বক্তব্য স্বার্থান্বেষী মহলের পছন্দ নাও হতে পারে। তারপরও আশায় বুক বেঁধে থাকলাম।
কাজী রফিকুল আলম : সম্পাদক ও প্রকাশক আলোকিত বাংলাদেশ।