বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধী দলের অনড় রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে যে দুঃসহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিদেশি দূতাবাসগুলো। ঢাকার একাধিক বিদেশি দূতাবাস থেকে গতকাল নিজ নিজ দেশে ২৯ ডিসেম্বরের ঘটনা বিষয়ক প্রতিবেদন পাঠানো হয় বলে সূত্রের খবর। আগামী কয়েক দিন ঢাকা থেকে যাওয়া প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ইউরোপীয় জোটসহ প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে ‘পরবর্তী পদক্ষেপ’ নেবে বলেও কূটনৈতিক সূত্র জানায়।
এদিকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক সহিংসতা আরও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন বিদেশি কূটনীতিকরা নিজেদের চলাচল কমিয়ে দিয়েছেন। বড়দিনের ছুটিতে অনেক কূটনীতিক নিজ দেশে গেলেও অন্যরা প্রয়োজনীয় কাজ এবং সরকারি অনুষ্ঠান ছাড়া দূতাবাসের বাইরে যাচ্ছেন না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হানা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন, জার্মানির রাষ্ট্রদূত আলব্রেখট কোনজে অবশ্য বড়দিনের ছুটিতে বাংলাদেশের বাইরে গেছেন। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণও ছুটি নিয়েছেন। যদিও তিনি দেশের বাইরে যাননি।
রবিবারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ঢাকার কূটনীতিকদের গতকাল অনেকটাই ব্যস্ত সময় কাটে। যদিও কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা ছুটিতে দেশের বাইরে গেছেন। তবে রাজনৈতিক শাখার কর্মকর্তা বা অন্য দায়িত্বশীলরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। তারা বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে গণমাধ্যমের সরসরি সম্প্রচার ও সংবাদ পর্যালোচনাও করেন। এর মাধ্যমে প্রতিবেদন তৈরির উপকরণ তারা পেয়ে যান।
ঢাকায় ইউরোপীয় একটি দূতাবাসের এক কর্মকর্তা গতকাল সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদককে বলেন, রবিবার বিকালে খালেদা জিয়া দলের প্রধান কার্যালয়ে যেতে পারবেন কি না তা আমরা সকাল থেকেই জানতে আগ্রহী ছিলাম। বিকালে যখন তাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হলো না, এরপর আমরা আমাদের দেশের পররাষ্ট্র দফতরে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিয়েছি। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমি যা দেখি, তাতে সহিংসতার একটি সংস্কৃতি রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল বা বিরোধী সবাই কোনো না কোনো সময় সহিংস রাজনীতির চর্চা করেছে। এক্ষেত্রে সহিংসতা দমনে এদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে সচেষ্ট হতে হবে। ইউরোপীয় প্রভাবশালী দেশের ওই কূটনীতিক আরও বলেন, সব মিলিয়ে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিধি আরও বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, ডান বা বাম বা মধ্যপন্থী যারাই থাকুক না কেন, নিজেদের মতবাদ বা মত স্বাধীনভাবে প্রকাশের সুযোগ পাওয়াও যেমন জরুরি, তেমনি শান্তিপূর্ণ উপায়ে মতপ্রকাশের চর্চাও করতে হবে। কারণ গণতন্ত্রে সহিংসতার কোনো স্থান হতে পারে না। দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এভাবে অব্যাহত থাকলে আমাদের দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুব শীঘ্র নতুন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে সেই ‘নতুন সিদ্ধান্ত’ কী হবে তা অবশ্য ওই কর্মকর্তা অনুমান করতে পারছেন না।
ঢাকায় অপর একটি দেশের এক মধ্যম সারির কর্মকর্তার সঙ্গে ওই দূতাবাসের বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গণমাধ্যমের জন্য একটি বক্তব্য দেয়ার ইচ্ছা রয়েছে রাষ্ট্রদূতের। তবে পরিস্থিতি আরও কিছুটা পর্যালোচনা শেষে এই বিবৃতি নিজ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকাশ করা হবে।
বিরোধী দলের কর্মসূচি ও খালেদা জিয়াকে বাড়ির বাইরে না যেতে দেয়ার বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে এশীয় প্রভাবশালী একটি দেশের দূতাবাস সূত্র জানায়, বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে আমরা অনেকটাই বিরক্ত। কারণ আলোচনার মাধ্যমে যেখানে সমস্যা সমাধানের একাধিক উদ্যোগ একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভেস্তে গেছে, সেখানে এখন দুই জোটই মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছে। শান্তিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা একান্তই প্রয়োজন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে পুরো এশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের একটি যোগসূত্র তৈরির সময় এসে এভাবে অশান্তি তৈরি হওয়ায় ভবিষ্যতের কূটনীতিও হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে ওই কূটনীতিক মন্তব্য করেন।
দশম জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়েছে সরকার। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে না’ এ যুক্তিতে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কথা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে। ব্রিটেন ও তাদের উপনিবেশে থাকা ৫৪ দেশের জোট কমনওয়েলথ এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়। এর আগে ২৮টি দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) কোনো পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানায়। এছাড়া চীন, জাপান, কানাডা, রাশিয়াসহ অনেক দেশ চিঠি না দিলেও মৌখিকভাবে কোনো ধরনের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কথা জানিয়েছে। সার্ক, বিমসটেক কিছু না জানালেও বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সিদ্ধান্তকেই মৌন সমর্থন জানাবে বলে কূটনীতিকদের ধারণা। বাংলাদেশের মতো উঠতি গণতন্ত্রের একটি দেশে নির্বাচন আয়োজনে বিদেশি সনদপত্র অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নেয়া হয়।