টেকনাফ শহরের প্রাণকেন্দ্র নাফ নদীর পাশে টেকনাফ পুলিশ ফাঁড়ির চত্বরে এই মাথিনের কূপ। এই কূপের পেছনে রয়েছে এক বেদনাবিধুর প্রেম কাহিনী। রাখাইন জমিদারকন্যা মাথিন আর এক পুলিশ কর্মকর্তার প্রেম সময়কে জয় করে নিয়েছে প্রেমের বিরহ, অপেক্ষা আর প্রয়াণের কাব্যে। ঐতিহাসিক প্রেমের এই দুই নর-নারীর আখ্যান আজও মনে নাড়া দিয়ে যায়।
মাথিনের প্রেম জয় করেছে সময়কে। প্রেয়সীর জন্য অপেক্ষার অনন্য এক নিদর্শন এই প্রেম। প্রেম এমনই প্রগাঢ় ছিল যে, মাথিন ভালোবাসার মানুষকে না পেয়ে সময়কে পেছনে ফেলে অনিদ্রা আর অনাহারে নিজের প্রিয় প্রাণকে উৎসর্গ করেছিলেন। আর দশজন সাধারণ রাখাইন কন্যার মতো ছিল জমিদার-কন্যা মাথিন। কিন্তু তার সাবলীল প্রেমের পরিণতি গিয়ে ঠেকেছে বিষাদ আর বেদনায় নীল হয়ে। কালজয়ী তার ট্র্যাজিডিক প্রেম এখনো মন নাড়িয়ে দেয় সাধারণে। ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ তাই পর্যটক থেকে শুরু করে প্রেম-পিয়াসী মানুষদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে আছে দেশের পূর্ব-দক্ষিণ সীমান্ত উপজেলার টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডে। এটি আধুনিক বিংশ শতকের শুরুর দিকের ঘটনা। নাফ নদীর কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা এ উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ। রাখাইন জমিদার-কন্যা মাথিন তার নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে বুঝিয়ে গেছেন, প্রেম মানে নিবেদিত প্রাণের সাধনা। সে কারণেই হয়তো মাথিনের প্রেম-কাহিনী ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। এ প্রেম ছিল নির্মোহ, তাদের প্রেমের স্মৃতি টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডের অভ্যন্তরে মাথিনের কূপ আজো বহমান। প্রতিদিন কূপটি দেখার জন্য এখানে বহু পর্যটক ভিড় জমান। এই প্রেমের কাহিনী লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জুলেখা ও চণ্ডীদাস-রজকিনীর প্রেম-কাহিনীর চেয়ে কম নয়। মাথিনের করুণ পরিণতির প্রেম-কাহিনীর শুরু_ পুলিশ অফিসার ধীরাজ আর রাখাইন জমিদার-কন্যা মাথিনকে ঘিয়ে। তখন টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। অবয়বে সুদর্শন ধীরাজ ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। তখন দস্যুতা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে এবং ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার জন্য টেকনাফে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। সেই ফাঁড়িরই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আসেন তিনি। তার সময়ে আরও অনেক বেশি দুর্গম ও ভয়ঙ্কর জায়গা বলে পরিচিতি ছিল টেকনাফের। কলকাতা থেকে দুর্গম টেকনাফে আসা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। শিলাইদহ থেকে গোয়ালন্দ প্রথমে ট্রেনে, তারপর গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুর হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত স্টিমারে। সেখান থেকে স্টিম ইঞ্জিন ট্রেনে চেপে চট্টগ্রামের বাটালি স্টেশন।
কলকাতায় নিজের স্বজনদের ছেড়ে টেকনাফে কর্তব্যবোধের পরিচয় দিয়েই এসেছিলেন। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফ থানার অদূরে সমুদ্রের নীল জলরাশি সে এক অনবদ্য প্রাকৃতিক মুগ্ধতা। থানায় ধীরাজ ভট্টাচার্যের খুব একটা বেশি কাজের চাপ ছিল না। বেশির ভাগ সময়ই এখানে-সেখানে ঘুরে ফিরেই কাটাতেন। থাকতেন থানার আধাপাকা ঘরের একটি কক্ষে। একাকী, নিভৃত্বে নিজের কাজ নিয়ে সময় কাটাতেন ধীরাজ। কাজের ফাঁকে অবসর পেলে চলে যেতেন প্রকৃতির সানি্নধ্যে। তখন টেকনাফে সুপেয় পানির খুব অভাব ছিল। সমগ্র টেকনাফের মধ্যে থানা কম্পাউন্ডে তখন একমাত্র বিশাল একটি পানির কূপ ছিল। এই কূপেই সুপেয় পানির জন্য রোজ ভিড় জমাত স্থানীয়রা। আশপাশের রাখাইন তরুণীরাই বেশি আসত পানির পাত্র হাতে কূপে ফেলত বালতি। এ ছাড়া থানা কম্পাউন্ডে কেউ কেউ থানার ছোট্ট বাগানের শিউলী ফুল তুলত। রাখাইনদের চিরাচরিত পোশাকেই দেখা যেত কূপের কাছে। কলসি হাতে পানি নিতে আসা এমন এক সুন্দরী রাখাইন যুবতীর মৃদু কণ্ঠে ভেসে আসা সুরলা মধুর গান শুনে মুগ্ধ হন ধীরাজ। নিজেরই অজান্তেই প্রেমে পড়ে যান তিনি। এরই মধ্যে একদিন স্থানীয় জমিদার ওয়াং থিনের একমাত্র রূপবতী কন্যা মাথিনকে দেখে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেন ধীরাজ। এরপর থেকে প্রতিদিন ভোর বেলায় থানার বারান্দায় বসে মাথিনের আসা-যাওয়া দেখতেন আর হৃদয় দেওয়া নেওয়ার একপর্যায়ে তাদের দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে ভালোবাসার সম্পর্ক। অন্য তরুণীরা আসার আগেই মাথিন কুয়ায় আসতেন এবং জল নিয়ে ঘরে ফিরতেন। একে অন্যের প্রেমে মশহুল হয়ে সম্ভব-অসম্ভব নানা জল্পনা কল্পনার স্বপ্ন জালে আবদ্ধ হয় ধীরাজ ও মাথিন। প্রণয়কে পাকা করতে এক সময় নিজেরা বিয়ের জন্যও প্রস্তুতি নেন। কিন্তু সমাজের আচারের বাইরে যেতে রাজি ছিলেন না মাথিন। বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়েই নিজস্ব রীতিতে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিলেন তারা। এর সূত্র ধরেই নানা বাধাসত্ত্বেও দুজনের মধ্যে বিয়ে কথা পাকাপাকিও হয়। সব ঠিক ছিল। বিয়ের ক্ষণও ঘনিয়ে এসেছিল। যখন সব ঠিকঠাক বিয়ের ক্ষণ গোনাতেও বাকি নেই বেশি দিন, তখনই অযাচিত বাধা আসে। মন দেওয়া নেওয়ার কিছুদিন যেতে না যেতেই কলকাতা থেকে হঠাৎ একদিন দারোগা ধীরাজের কাছে ব্রাহ্মণ পিতার জরুরি টেলিবার্তা আসে। যেখানে তার বাবা লিখেছিলেন খুব জরুরিভাবে তাকে কলকাতা যেতে হবে। বাবার টেলিগ্রাম পেয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ধীরাজ। তবে যাওয়ার আগে দ্রুত ফিরে এসে মাথিনকে বিয়ে করার প্রতিশ্রতি দিয়ে চলে যাওয়ার পর ধীরাজ আর ফিরে আসেননি। কিন্তু মাথিনের যৌবনের জোয়ারে মনে তখন ধীরাজের জন্য অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চায় না। মনের মানুষের জন্য তার অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন। ভালোবাসার মানুষের ফিরে আসার অধির অপেক্ষায় দিন গুনতে গুনতে অনাহার-অনিদ্রায় মৃত্যুদূতের হাতে নিজেকে সমর্পণ করেন মাথিন। সেই থেকে পাতকুয়াটির নামকরণ হয় ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ। এদিকে ১৯৩০ সালে ধীরাজ ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত জীবনী নিয়ে লেখা যখন পুলিশ ছিলাম গ্রন্থে তারই ভালোবাসার স্মৃতি আদরিণী মাথিনের কথাও লিখেছেন। লাহোরের ওবাইদুলাহ রোডের জিলানি ইউনিক প্রেস থেকে ১৯৩০ সালের ১ আষাঢ় বইটি প্রকাশিত হয়।
ওই বইয়ের বিখ্যাত চরিত্রে মাথিনের কূপ সংশ্লিষ্ট কাহিনীটি রচিত রয়েছে। তবে ভালোবাসার জন্য রাখাইন জমিদার-কন্যা মাথিনের এই জীবন বিসর্জন কাহিনী কোনোভাবেই মানতে রাজি নন টেকনাফের রাখাইনরা। তাদের দাবি, মাথিন কূপের এই প্রেম-কাহিনী সাহিত্যিক পুলিশ অফিসার ধীরাজের লেখা উপন্যাসের কল্পিত চরিত্রের ইতিহাস মাত্র। বর্তমানে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি হাজারো নারী-পুরুষ পর্যটক টেকনাফের ঐতিহাসিক মাথিনের কূপটি পরিদর্শনে ভিড় জমান। যেখান থেকে এ সময়ের প্রেমিক-প্রেমিকরা মাথিন ও ধীরাজের অমর প্রেম-কাহিনী নিদর্শনের মধ্য দিয়ে তারা যে যার মতো নিজেদের পবিত্র প্রেম-ভালোবাসাকে মিলিয়ে নিচ্ছেন। ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজের অমর প্রেম-কাহিনী ও তার স্মৃতিবিজড়িত। মাথিন নিশ্চিত ছিলেন না, তার মনের মানুষ আজও ফিরে আসবে কিনা, তবু অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে এতটুকু দ্বিধাগ্রস্থ হননি। আত্দবিসর্জন করেই অমর প্রেমের নিদর্শন খচিত আছে মাথিনের কূপে।