বিরোধী জোটের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ ঘিরে টানটান উত্তেজনা দেশজুড়ে। এ কর্মসূচি সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি বিরোধী জোটের। ঠেকাতে মরিয়া সরকার ও সরকারি দল। দুই পক্ষের কঠোর অবস্থানে জনজীবনে ছড়িয়ে পড়েছে শঙ্কা আর উদ্বেগ। কর্মসূচি ঠেকাতে গতকাল থেকে কার্যত অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে সারা দেশে। বাস, লঞ্চ চলাচল অনেক স্থানে বন্ধ হয়ে যায় গতকাল থেকেই। মহাসড়কে বসানো হয়েছে কড়া নজরদারি। স্থানে স্থানে যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানী ও আশপাশের জেলায় চলছে গণগ্রেপ্তার। বাসা-বাড়ি, মেস ও আবাসিক হোটেলে চালানো হচ্ছে বিশেষ অভিযান। রাজধানীর আবাসিক হোটেলগুলোতে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বিরোধী জোটের অবরোধের পর এবার সরকারিভাবে দেয়া অবরোধের কবলে পড়তে যাচ্ছে দেশ। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বানচালের চেষ্টা করা হলেও কর্মসূচি হবেই। তা সফল করতে সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীরা ঢাকা অবস্থান নিচ্ছেন বলেও তারা জানিয়েছেন। এদিকে বিরোধী জোটের কর্মসূচিতে পতাকা হাতে অংশ নেয়ার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আহ্বান জানালেও বিভিন্ন স্থানে জাতীয় পতাকা তৈরিতে বাধা দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পতাকা তৈরির কারণে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে দর্জি দোকানিকে। এদিকে কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৮ দলের পক্ষ থেকে রাজধানীর নয়া পল্টনে গণজমায়েতে বিরোধী নেত্রীর নিরাপত্তা দেয়া ও মাইক ব্যবহারের জন্য সহযোগিতা চাওয়া হলেও গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশ জননিরাপত্তার কথা বলে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে। গতকাল মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, জননিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে ওই দিন ঢাকায় কোন সমাবেশের অনুমতি না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশানে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এর এক দিন পর গত বুধবার ২৯শে ডিসেম্বর ঢাকা অভিমুখে অভিযাত্রা কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত ও সহযোগিতা চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশকে (ডিএমপি) দুটি চিঠি দেয় বিএনপি। একটি চিঠিতে ২৯শে ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জমায়েতে খালেদা জিয়া ও দলীয় নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং অপর চিঠিতে মাইক ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু গতকাল ডিএমপির পক্ষ থেকে গণজমায়েতের অনুমতি দেয়া হবে না বলে জানানো হয়। এদিকে রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বরিশাল থেকে ঢাকামুখী বাস ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। চট্টগ্রামে বাসের টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয় রাত থেকে। চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর থেকে গতকালই সব ধরনের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। যশোর থেকে বাস চললেও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের টিকেট দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ১৮ দলের নেতাকর্মীরা। রংপুর থেকে ঢাকাগামী বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাজশাহী ও ঝিনাইদহ থেকে ঢাকাগামী সব ধরনের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গত রাত থেকে।
সরকার নিজেই হরতাল ও অবরোধ দিয়েছে: মঈন খান
সারা দেশে বাস, ট্রেন ও লঞ্চসহ সব ধরনের যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে সরকার নিজেই হরতাল ও অবরোধের ডাক দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান। গতকাল রাতে জাতীয় প্রেস ক্লাবে তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন। মঈন খান বলেন, ২৯শে ডিসেম্বর বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ ভণ্ডুল করতে সরকার সকল যানবাহন বন্ধ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে দিয়ে সরকার হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে। তিনি বলেন, সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে ২৯শে ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’তে বাধা না দিয়ে অনুমতি দিবে। দেশের মানুষ আমাদের কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সরকার এই গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে বাধা দিলে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটবে। বিএনপির এ সিনিয়র নেতা বলেন, গণতন্ত্র বাঁচাতে এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় খালেদা জিয়া ২৯শে ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি আহ্বান করেছেন। এ আন্দোলনে অংশ নিতে সকল শ্রেণী-পেশার, ধর্ম-বর্ণের মানুষকে আহ্বান করেছেন তিনি। এখন দেশের সব মানুষ একটাই সমস্যা অনুভব করে, সেটা হলো গণতন্ত্র মৃত্যুর পথে। বিএনপি যে আন্দোলন করছে তা সকল মানুষের আন্দোলন, গণতন্ত্র বাঁচানোর আন্দোলন। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বানচাল করতে ইতিমধ্যে সরকারের উচ্চ মহল থেকে অপচেষ্টা শুরু হয়েছে অভিযোগ করে মঈন খান বলেন, আমরা বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখেছি, সরকারের উচ্চ মহল থেকে কর্মসূচি করতে দেবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ সরকারের একতরফা নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বিরোধী দল ব্যতীত নির্বাচনে ভোট প্রদান করবে না বলে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তাই ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ায় আগামী ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ব্যর্থ হয়েছে। এটা ১৮ দলের আন্দোলনের ফসল। ২৯শে ডিসেম্বরের কর্মসূচির অনুমতি দেয়া হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, আমরা ডিএমপির কাছে লিখিত অনুমোদন চেয়েছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে তার কোন জবাব আসেনি। তবে, আমরা আশা করি সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং দেশ ও জাতির স্বার্থে কর্মসূচির অনুমতি দেবে। খালেদা জিয়া গৃহবন্দি কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে মঈন খান বলেন, দেশনেত্রীর বাসায় কাউকে যেতেও দেয়া হচ্ছে না, তার বাসা থেকে কাউকে বেরও হতে দিচ্ছে না সরকার। নেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অবরুদ্ধ করে রেখেছে। যদি বিরোধী দলকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা না দেয়া হয়, তাহলে একে বহুদলীয় গণতন্ত্র না বলে, একদলীয় বাকশাল বলা যেতে পারে। সরকার একদলীয় বাকশাল কায়েমের চেষ্টা করছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও যৌথবাহিনী সম্পর্কে তিনি বলেন, আপনারা দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন-ভাতা ও সুযোগ সুবিধাদি পেয়ে থাকেন। আপনারা ন্যায়-নীতিকে সামনে রেখে মানুষের সেবা করবেন। আপনারা জনগণের সেবার জন্য, কোন দলের আজ্ঞাবহ হওয়া জন্য নয়। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের সেবা না করে সরকারি দলের আজ্ঞাবহ হয়ে বিরোধী দল দমনে মেতে উঠেছে বলেও অভিযোগ করেন মঈন খান। আইন-শৃংখলা বাহিনী বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘর ভাঙচুর এবং পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করছে অভিযোগ করেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি ও শামীমুর রহমান শামীম উপস্থিত ছিলেন।
বাউফল (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, ১৮ দলীয় জোটের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ ঠেকাতে গতকাল পটুয়াখালীর বাউফলের কালাইয়া ঘাট থেকে ঢাকাগামী কোন ডাবল ডেকার লঞ্চ ছেড়ে যায়নি। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ১২ই মার্চের সমাবেশের মতো এবারেও বিএনপি জোটের ডাকা রোববারের গণজমায়েত উপলক্ষে লোকসমাগম ঠেকাতে কালাইয়া ঘাট থেকে ঢাকা-কালাইয়া রুটের কোন ডবল-ডেকার লঞ্চ ছাড়তে দেয়নি সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। কালাইয়া ঘাটের পন্টুনে নোঙর করা ডবল ডেকার লঞ্চ ‘মশিরুন খান’ এর ইন্সপেক্টর আলম বলেন, ‘জাহাজ কি জন্য ছেড়ে যাচ্ছে না তা কি আপনি বুঝেন না? এ ব্যাপারে বেশি কিছু বলতে পারবো না।’