আগামী ২৯ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের ‘ঢাকা অভিযাত্রা’ কর্মসূচি কেন্দ্র করে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামছে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবির। ‘ডুু অর ডাই’ মনোভাব নিয়েই মাঠে থাকছেন তাদের নেতাকর্মীরা। এ কর্মসূচির আড়ালে তারা বড় ধরনের নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে। রাজধানী ও এর আশপাশের জেলা অচল করে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে জামায়াতের। এছাড়া হেফাজতের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী জোটের এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে যাবতীয় প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছেন। তবে তারা হেফজতের ব্যানারে নয়, ১৮ দলীয় জোটের অন্যান্য দলের হয়ে সক্রিয় অংশ নেবেন। ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মী ঢাকায় অবস্থান নিয়েছেন।
জামায়াতের এক নীতিনির্ধারক বৃহস্পতিবার বর্তামানকে বলেন, ‘রাজধানী ছাড়া দেশের প্রত্যেকটি এলাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন এখন তুঙ্গে; কিন্তু বিএনপির দুর্বলতার কারণে দেশের প্রধান এ শহরে কিছুই করা যাচ্ছে না। জাতীয় নির্বাচনও আসন্ন। আন্দোলনে রাজধানী অচল করা না গেলে দ্রুত সময়ে সরকার পতন কখনও সম্ভব নয়। তাই এবার আমরা নিজেরাই মাঠে থাকব।’
এই নীতিনির্ধারক আরও জানান, আগামী ২৯ ডিসেম্বর জোটের কর্মসূচিকে জামায়াত-শিবির আন্দোলনের ‘ফাইনাল রাউন্ড’ মনে করছে। সেই হিসাব করেই মাঠে নামছেন তাদের নেতাকর্মীরা। যে কোনো মূল্যে সরকারের পতন ঘটিয়ে জামায়াত তাদের শীর্ষনেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি এবং এতদিনের নিহত নেতাকর্মীর বদলা নিতে চায়। অন্যথায় সামনের দিনগুলোয় জামায়াত-শিবিরকে আরও কঠিন সময় পার করতে হবে। কাদের মোল্লার মতো অধিকাংশ শীর্ষ নেতাকে হারাতে হবে— এ বিষয়টি মাথায় রেখে ‘ডু অর ডাই’ মনোভাব নিয়েই জোটের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা।
সূত্রমতে, জামায়াত-শিবিরের এসব নেতাকর্মী জোটের নেতাকর্মীদের ছদ্মবেশে কর্মসূচি থেকে রাজধানী অচল করে দেয়ার প্রথম টার্গেট পূরণ করতে পারে। প্রয়োজনে তারা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও মোকাবিলা করবে। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। এছাড়া পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে রাজধানীর শাপলা চত্বরসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দখল করে নিতে পারে। মঞ্চ তৈরি করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারে বলেও জানা গেছে।
দলটির ঘনিষ্ঠ সূত্র আরও জানায়, ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি লোক সমাগমের টার্গেট নিয়েছে জামায়াত। দেশের জেলা-উপজেলা, বিভাগীয় শহর, বিশেষ করে রাজধানী ও এর আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে কমপক্ষে তাদের পাঁচ লাখ নেতাকর্মী জোটের কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। কর্মসূচির দুদিন আগেই জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীদের রাজধানী ও এর আশে পাশে চলে আসতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে তাদের নেতাকর্মীরা নানা ছদ্মবেশে রাজধানীতে আসা শুরু করেছেন। যারা চলে এসেছেন তারা জামায়াত-শিবির সমর্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ডেভেলপার কোম্পানি, ব্যাংক-বীমা ইত্যাদির কর্মকর্তা-কর্মচারী সেজে ঢাকায় অত্যন্ত সতর্কভাবে চলাফেরা করছেন। পুলিশের নজরদারি এড়াতে তাদেরকে এসব প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড দেয়া হচ্ছে। তাদের অনেকেই প্রেসকার্ড ব্যবহার করে গোপনে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন বলেও জানা গেছে।
সূত্রমতে, শুক্রবার জুমার নামাজের পর থেকে বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীরা রাজধানীতে প্রকাশ্য সাংগঠনিক তত্পরতায় অংশ নেবেন। জামায়াত-শিবির ঢাকা মহানগরীর নেতৃত্বে এসব নেতাকর্মীকে ঢাকা অভিযাত্রা কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত একাত্ম হয়ে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, কর্মসূচির দিন ভোর থেকেই ঢাকার কমপক্ষে ২০টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ওঁত্ পেতে থাকবে জামায়াত-শিবিরের একাধিক গ্রুপ। বড় একটি গ্রুপ থাকবে জোটের সমাবেশস্থলে। কর্মসূচি কেন্দ্র করে বড় ধরনের শোডাউন করবেন তাদের নেতাকর্মীরা। রাজধানীর প্রত্যেকটি থানা থেকে জামায়াত-শিবিরের কমপক্ষে ১০ হাজার নেতাকর্মী-সমর্থক যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। এসব নেতাকর্মীসহ সব মিলিয়ে কর্মসূচিতে পাঁচ লাখ লোক সমাগমের টার্গেট করেছে জামায়াত।
অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে জোটের কর্মসূচিতে সহায়তা করতে চায় হেফাজতে ইসলাম। এজন্য দেশের প্রত্যেক জেলা-উপজেলা থেকে তাদের নেতাকর্মীদের নিরীহ ছাত্র-শিক্ষকসহ নানা ছদ্মবেশে আগেভাগেই রাজধানীতে চলে আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দলটির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংগঠনটির ব্যানারে নয়, তাদের সমর্থিত যেসব রাজনৈতিক দল ১৮ দলীয় জোটের শরিক সেসব দলের তত্ত্বাবধানে হেফাজতের নেতাকর্মীরা ঢাকা অভিযাত্রা কর্মসূচিতে আসা শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে রাজধানীর কওমি মাদ্রাসা ও মসজিদে তাদের অনেকেই চলে এসেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে তারা উঠছেন রাজধানীর লালবাগ মাদ্রাসা, কামরাঙ্গীরচর নূরিয়া মাদ্রাসা, বারিধারা জামিয়া মাদানিয়া, যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসা, মোহাম্মদপুর মাদ্রাসাসহ ঢাকা শহর ও আশপাশের জেলায় অবস্থিত কওমি মাদ্রাসা এবং তাদের সমর্থিত প্রতিষ্ঠানে। কেউ কেউ টঙ্গীর বিশ্ব তবলিগ জামাতের ময়দানের আশপাশে নেতাদের বাসা-বাড়ি, প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর দোয়া দিবসের কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে রাজধানীতে তাদের দেখা যেতে পারে। তবে হেফাজতের দায়িত্বশীল নেতারা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
হেফাজতের ঢাকা সমন্বয়কারী মাওলানা জাফরুল্লাহ খান বর্তমানকে বলেন, ‘হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। ১৮ দলীয় জোটের কোনো কর্মসূচিতে সংগঠনটির সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। তবে জোটের শরিক অন্য দলের সদস্য হিসেবে তাদের কোনো নেতাকর্মী যদি এ কর্মসূচিতে অংশ নেন, তাহলে হেফাজতের কিছু করার নেই।’
অরাজনৈতিক এ সংগঠনটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, সাড়ে পাঁচ বছর ধরে কওমি ইসলামী দলগুলো ইসলাম রক্ষার ব্যানারে সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে কোনো সুবিধা করতে পারেনি। একপর্যায়ে ইসলামের অবমাননা ও নাস্তিক ইস্যুতে মাওলানা আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজতের ব্যানারে গড়ে তোলা হয় ১৩দফার আন্দোলন। ৫ মে শাপলা চত্বরের সমাবেশ উচ্ছেদ করার মধ্যদিয়ে সেই আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। এতে হতাহত হয়েছেন অনেক নেতাকর্মী— অভিযোগ হেফাজতের। সেই থেকে মামলা-মোকদ্দমাসহ নানাভাবে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিরোধ ব্যবস্থা অব্যাহত আছে। কর্মসূচি নিয়েও মাঠে নামতে দেয়া হয়নি তাদের। সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর শাপলা চত্বরে আবারও সমাবেশ করতে চেয়েছিল হেফাজত; কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টাও শেষ হয়ে যায়। সবমিলিয়ে এসব ঘটনায় সরকারের ওপর চরম প্রতিশোধ নিতে চায় হেফাজতে ইসলাম। রাজধানীতে জোটের ঢাকা অভিযাত্রা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন তরান্বিত করতে বিশেষভাবে সহায়তা করবে সংগঠনটি।
জানা গেছে, ১৮ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে মুফতি আবদুল লতিফ নেজামী ও মুফতি ফয়জুল্লাহর ইসলামী ঐক্যজোট, মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফের বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাসের জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, মাওলানা ইছহাকের খেলাফত মজলিশসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল হেফাজতে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত। এসব দল বুধবার পৃথক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জোটের কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছে।