এমন বছর কখনো চায়নি বাংলাদেশ। আগুনে পুড়ে কয়লা হয়েছে শরীর, কংক্রিটের দেয়ালে চাপা পড়েছে মানবতা। অন্তিম শবযাত্রা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। যেন মৃত্যুর এক বছর পার করছে বাংলাদেশ।
২০১৩ সালের পুরোটাই যেন সহিংস রাজনীতি আর ভয়াবহ কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনার খতিয়ান। বেড়েছে অপরাধ; নৃশংস খুন। অস্বাভাবিক মৃত্যুর হিসাব রাখতে রাখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন গবেষকেরা।
সারা বছরে কত মানুষ অস্বাভাবিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন, তার নিখুঁত ও নির্ভুল পরিসংখ্যান বের করা রীতিমতো অসম্ভব। তবে একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুসারে, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনা ও সহিংসতায় এ পর্যন্ত অন্তত দুই হাজার ১২৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে মৃত্যু, সীমান্তে সহিংসতা, গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা যোগ করলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৬৬ জন! এই পরিসংখ্যান পূর্ণাঙ্গ নয়। কারণ, বছর শেষ না হওয়ায় অনেক সংগঠনগুলোর চূড়ান্ত হিসাব এখনো শেষ হয়নি। সাধারণ খুন, অরাজনৈতিক ও পারিবারিক সহিংসতা, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা প্রকারের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা এখানে অনুপস্থিত।
সহিংস রাজনীতি, বিপন্ন জীবন: দেশের রাজনীতি যেন দিনে দিনে মানবিক চেহারা বাদ দিয়ে নির্দয় আর হিংস্র চেহারা নিয়েছে। শুধু কাগজে-কলমে মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে এই হিংস্রতা বোঝানো যাবে না। বরং কীভাবে মানুষ মারা গেছেন, তার খতিয়ান বের করতে হবে। পিটিয়ে বা কুপিয়ে বা জবাই করে বর্বরভাবে হত্যার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা। পোড়া শরীর নিয়ে মৃত্যুর চেয়েও বেশি যন্ত্রণা ভোগ করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন মানুষগুলো। ক্ষমতালিপ্সুদের হত্যার রাজনীতিকে অভিসম্পাত করা ছাড়া আর কিছুই তাঁদের করার নেই।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়েছেন ৪৯২ জন। ৮১৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তাতে আহত হয়েছেন আরও ২২ হাজার মানুষ। আর এর মধ্যে ৯৪ জন আগুনে পুড়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ২১ জন মারা গেছেন।
রাজনৈতিক সংঘাতে এত প্রাণহানি সর্বশেষ ঘটেছিল ২০০১ সালে। ওই বছর ৫০০ মানুষ রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারান। আর গত ২২টি ‘গণতান্ত্রিক’ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন অন্তত আড়াই হাজার।
বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সংঘাতে মৃত্যু অব্যাহত থাকার কারণ দুটো। এক, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে অনৈক্য; দুই, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। ২৯ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। হরতাল দেয় জামায়াত, প্রাণ হারান তিনজন। সেই শুরু। ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হলে দেশের বিভিন্ন জেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এক সপ্তাহের নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞে দেশের ১৮ জেলায় ৭৭ জন সহিংসতায় নিহত হন। হিংসার আগুনে পুড়ে কয়লা হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রতিটি রায়ের আগে-পরে সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তবে সাঈদীর রায়ের পর মৃত্যুর সংখ্যা ছাপিয়ে গেছে আর সব কটিকে।
নিয়মিত বিরতিতে রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু হঠাৎ লাগাম ছাড়িয়ে গেছে বছরের শেষে এসে। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে অটল সরকারকে টলাতে প্রায় এক মাস ধরে চলেছে প্রধান বিরোধী জোটের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি। আর দেশে এখন হরতাল-অবরোধ মানেই সহিংসতা। প্রথম আলোর পরিসংখ্যান বলছে, ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত ৩০ দিনের মধ্যে সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি চলেছে ২৪ দিন। এই দিনগুলোতে অন্তত ১২০ জন মানুষ সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। মানুষ মরেছে গুলিতে, বোমায়, আগুনে, দুর্ঘটনায়।
চলমান রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আসে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি। ১০ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করে, চলে কয়েক দিন ধরে। ফলাফল, স্বজনহারা হয়েছে আরও কয়েকটি পরিবার।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালটা বাংলাদেশের জন্য খারাপ গেল। এ বছর সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষের সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে মানুষ। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, দুই দলের দুই নেত্রীই নিজ নিজ স্বার্থে রাজনীতি করেন। কেউই দেশের স্বার্থে রাজনীতি করেন না। তাঁরা দেশের স্বার্থ দেখলে এভাবে মানুষ মরত না। প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, শুধু সাধারণ মানুষই মারা যায়, কোনো নেতা মারা যান না। এটাই প্রমাণ করে, দলগুলো মানুষকে ব্যবহার করছে নিজেদের উদ্দেশ্যে। যেহেতু দুই নেত্রীর কারণে এই হানাহানি, তাই তাঁদেরই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
রানা প্লাজায় মানবতার ধস: এক রানা প্লাজাই ছাপিয়ে গেছে মানবমৃত্যুর সব পরিসংখ্যান। ২৪ এপ্রিল রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে ধসে পড়ে নয়তলা রানা প্লাজা। এক দিন আগেই ভবনটির গায়ে ফাটল দেখা গিয়েছিল। কিন্তু মালিকের চাপে ঝুঁকি উপেক্ষা করে সেখানে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানার প্রায় চার হাজার শ্রমিক। যার ফলে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ এই কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এক হাজার ১৩৪ জন। ২০ দিন ধরে চলা উদ্ধারকাজে ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত উদ্ধার হন দুই হাজার ৪৩৮ জন। এখনো নিখোঁজ আছেন দুই শর বেশি শ্রমিক।
এ দেশে বরাবরই কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার হার বেশি। যখন-তখন উঁচু থেকে পড়ে বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান নির্মাণশ্রমিক, সড়ক দুর্ঘটনায় নির্মমভাবে প্রাণ হারান পরিবহনশ্রমিক, তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে মারা যান শ্রমিকেরা। গত ১০-১২ বছরের কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানের ওপর চোখ বোলালে দেখা যাবে, প্রতিবছরই গড়ে তিন শতাধিক মানুষ কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিসংখ্যান বলছে, রানা প্লাজায় নিহতদের বাদ দিলে বছরের প্রথম ছয় মাসেই কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনা ও সহিংসতায় ৫০২ জন মারা গেছেন।
বছরের শুরুর দিকে ২৬ জানুয়ারি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে স্মার্ট এক্সপোর্ট লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানায় সাত নারী শ্রমিক মারা যান। রানা প্লাজায় নিহতের সংখ্যা যখন প্রতিদিন বেড়েই চলছিল, তার মধ্যেই ৮ মে মিরপুরের তুংহাই সোয়েটার লিমিটেডে আগুন লেগে মারা যান মালিক ও পুলিশ কর্মকর্তাসহ আটজন। ৮ অক্টোবর গাজীপুরের আসওয়াদ কম্পোজিট নামের পোশাক কারখানায় নয়জনের প্রাণহানি হয়।
না চাইলেও দুঃস্বপ্নের মতো এসব ঘটনা বারবার তাড়া করে ফিরছে দেশটাকে। ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসের আগুনে ১১২ জন আগুনে পুড়ে কয়লা হয়েছিলেন। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে রানা প্লাজা ধস। নতুন দুঃস্বপ্ন এসে আগেরটিকে ফিকে করে দিয়েছে মাত্র। আর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া রানা প্লাজা তো বাংলাদেশের নড়বড়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি।
থেমে নেই নৃশংস হত্যা, অন্যান্য মৃত্যু: স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তার বড্ড বেশি অভাব বাংলাদেশে। প্রায়ই নৃশংস ও চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনা পত্রিকার শিরোনামে উঠে আসে। পরিসংখ্যান দিয়ে এসব হত্যার মাত্রা বোঝা যায় না। তেমনই এক হত্যাকাণ্ড নারায়ণগঞ্জে মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা। নারায়ণগঞ্জের গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বিকে শায়েস্তা করতে ৮ মার্চ ১৭ বছরের ত্বকীকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। আর বছরের শেষ দিকে এসে ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর গোপীবাগে এক পরিবারের ছয়জনকে জবাই করে খুন করা হয়।
বছরজুড়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে আরও নানাভাবে। আসকের সর্বশেষ হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ১৮৯ জন, গণপিটুনিতে ১২৩ জন এবং সীমান্ত সংঘাতে ২৫ জন মারা গেছেন।
২০১৩ সালের এমন একটি দিন খুঁজে পাওয়া কঠিন, যেদিন দেশে কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। অস্বাভাবিক মৃত্যু পরিণত হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মে, নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবে।
এমন বছর আর কখনো চায় না বাংলাদেশ।