নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট দিনে দিনে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। রাজপথে সহিংসতা, সরকারি বাহিনীর অ্যাকশন, মৌলিক মানবাধিকার বিশেষত ভোটারদের পছন্দসই প্রার্থী নির্বাচিত করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা, সর্বোপরি সুশাসনের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। এর সরাসরি ধাক্কা লাগছে দেশের বিদ্যমান কূটনীতি ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর। প্রধান বিরোধী দলসহ বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখে একতরফা নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না- তা অনেক আগেই আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের তরফে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সবার অংশগ্রহণে সহিংসতামুক্ত একটি নির্বাচনের বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার বিষয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বিভিন্নমুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু নেতৃত্বের অনমনীয়তায় সব উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর বিশ্ব দরবার থেকে নির্বাচন প্রত্যাখ্যানসহ বিভিন্ন ধরনের ‘নেতিবাচক বার্তা’ দেয়া শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা এসেছে ইউরোপের ২৮ রাষ্ট্রের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে। দেশের সঙ্কটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সদর দপ্তরের নির্দেশে রিপোর্ট তৈরিতে ব্যস্ত থাকার কারণ দেখিয়ে ঢাকাস্থ ইইউ ডেলিগেশন প্রধান ও অন্য দূতরা বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন বর্জন করে। দল বেঁধে নজিরবিহীন এ বর্জনের মধ্য দিয়ে সরকার তো বটেই, উত্তাল হয়ে ওঠা বাংলাদেশের প্রতিও ইইউ ‘কঠিন বার্তা’ দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে সরকারের বহুমুখী চেষ্টা বিশেষ করে পেশাদার কূটনীতিকদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় ইইউ’র কূটনীতিকরা সেদিন বিকালে সিদ্ধান্ত পাল্টে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সংবর্ধনায় যোগ দেন। কর্মকর্তাদের মতে, ইইউ’র সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে। ওই জোটে থাকা দেশগুলোতে বৈধ-অবৈধ অনেক বাংলাদেশী রয়েছে। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তাছাড়া, বাংলাদেশী পণ্য বিশেষ করে তৈরী পোশাকের বড় বাজার ইউরোপের দেশগুলো। দেশের শ্রমমান প্রশ্ন তুলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশের শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত হলেও ইইউ এখনও সেই সুবিধাটি দিয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে, কেবল শ্রমমান নয়, মৌলিক মানবাধিকার বিশেষত ভোটাধিকার এবং সুশাসনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেন ইউরোপের ক্রেতারা। কিছু বিষয়ে তাদের অবস্থান সর্বজনীন। যে কোন গুরুতর অপরাধের বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ‘মৃত্যুদণ্ড’র বিরুদ্ধে ইইউ’র অবস্থান। তারা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিশেষ করে ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশে ভোটারদের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দেয় দেশগুলো। তবে সমানভাবে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ এবং রাজপথের যে কোন পক্ষের সহিংসতা ও বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে তাদের কঠিন অবস্থান রয়েছে। এসব বিবেচনায় বরাবরই ইউরোপ-জোটের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত স্পর্শকাতর। পররাষ্ট্র দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বিভিন্ন ফোরামে এটি খোলাখুলি বলে থাকেন। সে মতে তারা আচরণও করেন। কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ওই জোটের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান বর্জনের পর বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকাস্থ রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ‘পর্যবেক্ষণ না করার সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে ইইউ। তার পথ অনুসরণ করেছে কমনওয়েলথ, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। ব্রাসেলস থেকে এক বিবৃতিতে কঠিন এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ওই জোটভুক্ত বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া কয়েক হাজার শ্রমিক আটক কিংবা শর্তসাপেক্ষে মুক্ত রয়েছে। পররাষ্ট্র দপ্তরের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক সঙ্কট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সৃষ্ট টানাপড়েনে এবার বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী আটকদের ফিরিয়ে নিতে চাপ বাড়ছে। ঢাকার তরফে অবশ্য তাদের নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাইয়ের দাবি তোলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংক্রান্ত বিধি-বিধানের দোহাই দিয়ে তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া আপাতত ঠেকানো গেলেও অবৈধ হয়ে যাওয়া হাজার হাজার বাংলাদেশীর গ্রেপ্তারে পুরো ইউরোপ জুড়ে অভিযানের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। লিসবন মিশনে কর্মরত পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, বিস্তীর্ণ ইউরোপ জুড়ে অনেক বাংলাদেশী রয়েছেন। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বৈধভাবে এসে নানা কারণে অবৈধ হয়ে গেছেন। বিশ্ব মন্দা সত্ত্বেও তাদের কাজ রয়েছে। কেউ কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও কিছু দিন পর হাজিরা দেয়ার শর্তে মুক্ত হয়ে কাজ করছেন। এসবই সম্ভব হচ্ছে সুসম্পর্কের কারণে। এ সম্পর্কের কারণেই দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে বরাবরই ইইউ সংলাপ ও সমঝোতার তাগিদ দিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত হলেও সংস্থাটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি, বরং পাশে থেকেছে। কারখানায় কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে ঢাকাকে সহযোগিতাসহ সময় দিয়েছে। তাদের কিছু শর্তও ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে সেই শর্তগুলোও পূরণ না হওয়ায় আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইইউ’র সঙ্গে সুসম্পর্কের অবনতি হলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবসহ বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে বলে মনে করেন পেশাদার ওই কর্মকর্তা। তবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্পর্কের অবনতি ঠেকানো সম্ভব হবে বলে আশাবাদী পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা।