আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দৃশ্যত বন্ধুহীন হয়ে পড়ছেন দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও ঐহিত্যবাহী দল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এ দলটি ইতোমধ্যেই দেশে বিদেশে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। বলতে গেলে আওয়ামী লীগ এখন রীতিমতো কোনঠাসা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে যে সহিংস প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে তা এক কথায় নজিরবিহীন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো বড় রাজনৈতিক দল এতোটা কোণঠাসা হয়েছে বলে জানা নেই।
আওয়ামী সরকারের চূড়ান্ত পরিণতিতে যে কীভাবে আসবে সেটি এখনো ধারণা করা যাচ্ছে না। এর আগে কোনো দল এধরনের পরিস্থিতির শিকার না হওয়ার ঐতিহ্যবাহী এ দলটির পরিনতি এখনই আঁচ করা যাচ্ছে না।
মূলত একতরফা নির্বাচন করতে গিয়েই আওয়ামী সরকার একা হয়ে পড়েছে। অনেকেই এই নির্বাচনকে ‘ভয়াবহ’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
সুকৌশলে এবং সফলভাবে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে একাই নির্বাচনের পথে হাঁটছে আওয়ামী লীগ। সেই পথ চলায় দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টিকেও (জেপি) কাছে টানতে ব্যর্থ হয় আওয়ামী লীগ। মনে রাখতে হবে, জেপি এক সময়কার আওয়ামী লীগের অন্যতম বন্ধুভাবাপন্ন দল। কিন্তু আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আসলে জাতীয় পার্টির অবস্থান কী হবে সে সম্পর্কে কেউ জানে না। এ নিয়ে একটা ধোঁয়াশা এখনো রয়ে গেছে এবং এরই মধ্যে এ নিয়ে অনেক নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেছে। আরো কত বাকি তাইবা কে জানে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদকে চিকিৎসার নামে মূলত আটক করে রাখা হয়েছে। মাঝে মাঝে তাকে বিদেশে পাঠানো নিয়েও নানা কথা শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে জাতীয় পার্টিও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের কয়েকবছর আগের পিনোচে এবং সাদ্দাম হোসেনের স্বৈরশাসনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
তবে আওয়ামী লীগের জন্যে সুখবর হলো রওশন সমর্থিত জাতীয় পার্টির একাংশের সমর্থন পেয়ে আসছে হাসিনা সরকার। এছাড়া আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা অপর দলগুলোকে নামমাত্র দল বলাই চলে। স্বচ্ছ নির্বাচন হলে এইসব দল কোনো আসন লাভ করবে না বলেই সাধারণের বিশ্বাস।
উদাহরণস্বরূপ দিনাজপুরের ছয়টি আসনের কথা উল্লেখ করা যায়। এর মধ্যে একটি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে আওয়ামী লীগ প্রার্থী। কারণ এই আসনে প্রার্থী একজনই। অবশিষ্ট পাঁচ আসনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়াকার্স পার্টি। গত তিনটি নির্বাচনে এই পাঁচটি আসনে ওয়াকার্স পার্টি দেড় হাজার করে ভোট পেয়েছিলো।
এই একতরফা নির্বাচনে কোনো ভোট ছাড়াই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ১৫৪টি আসনে জয়লাভ করেছে। এই ঘটনা আওয়ামী লীগকে সাধারণ ভোটারদের থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
এই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করার ফলে প্রায় অর্ধেকের বেশি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকলো।
প্রার্থী আগেই জয়লাভ করার ফলে এই বিপুল সংখ্যক ভোটারের ভোট দেয়ার প্রয়োজনই পড়লো না। অবশিষ্ট ভোটারা ভোট দিতে উৎসুক নন, বা ভোট দেয়ার জন্যে উপযুক্ত কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না।
সুতরাং, আমরা প্রতিনিধিবিহীন এক সংসদের পথে এগুচ্ছি বলা যায়।
বাঙ্গালী ভোট দিতে ভালোবাসে। কারণ দেশের বিষয়ে মত প্রকাশের সুযোগ পাঁচ বছরে এই একবারই পায় তারা। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই অধিকারটুকুও থাকছে না তাদের।
দেশীয় প্রেক্ষাপটে নয়, বর্হিবিশ্বেও সমাদৃত হচ্ছে না এই নির্বাচন। শুধুমাত্র ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশই এই নির্বাচনকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক বলছে না।
এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কমনওয়েথ এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে প্রতিনিধি পাঠাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের সবগুলো দেশের কূটনীতিকরা এই নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে সরকার গঠিত হবে এমন প্রশ্নে অনেক কূটনীতিক হতাশা ব্যক্ত করেছে। এই পরিস্থিতি দেশের উন্নয়নকে চরমভাবে বাধাগ্রস্থ করবে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্রের পথে বহুদূর এসে এখন তাদের নিজেদের পথ থেকেই দলটি বিচ্ছিন্ন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাদের মাধ্যমে পরিচালিত দলটি আজ নিজেই গণতন্ত্রের পথে নেই।