খালেদার নতুন কর্মসূচী, সংঘাত-শঙ্কা ঃ অনুমতি দেবে না সরকার

0
104
Print Friendly, PDF & Email

বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার নতুন কর্মসূচী ঘিরে দেশে আরেক দফা ভয়াবহ সংঘাতের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। হেফাজতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে আগামী ২৯ ডিসেম্বর ঢাকামুখী পদযাত্রার কর্মসূচী পালনের অনুমতি যে সরকার দেবে না, তা ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। উল্টো ওইদিন মাঠে থাকার ঘোষণা দিতে পারে শাসক দল আওয়ামী লীগও। যে কোন মূল্যে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠান আর প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মুখোমুখি কঠোর অবস্থানে ঢাকাসহ সারাদেশে ভয়াবহ সংঘাতের আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে দেশের মানুষ।

এমনিতেই জামায়াত-শিবিরের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই বিএনপির। বিএনপির ডাকা কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী সন্ত্রাসনির্ভর এ দলটি। গত একমাস ধরে রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে জামায়াত-শিবিরের ভয়াল নৃশংসতায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এসব সহিংসতার দায় এড়িয়ে উল্টো সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্য জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের আরও উৎসাহিত করবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

গত ৫ মে রাজধানীতে হেফাজতের নারকীয় তা-বের উদাহরণ তুলে ধরে তাঁরা আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলছেন, গণতান্ত্রিক কর্মসূচীর সুযোগ নিয়ে হেফাজতের মতোই জামায়াত-শিবির রাজধানীতে ভয়াবহ সংঘাত ও নাশকতা চালিয়ে দেশে একটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেত্রীর ঘোষিত ঢাকামুখী অভিযাত্রার সফলতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে দলটির তৃণমূলে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে সারাদেশে সশস্ত্রবাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন এই কর্মসূচী সফল করা নিয়ে সংশয়ের মধ্যে আছেন বিএনপির নেতারা।

সংবাদ সম্মেলনে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার কিছু বক্তব্য নিয়ে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- নিয়ে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে সারাদেশে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও খালেদা জিয়া এ ব্যাপারে কোন নিন্দা জানাননি। ‘পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রতিক্রিয়ায় আমি মর্মামত’Ñশুধু এটুকু বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে তাঁর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে চার অপরাধের সঙ্গে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বঙ্গবন্ধু কোন ক্ষমা করেননি। বরং বঙ্গবন্ধুর সময়ই প্রায় ৭০ হাজার যুদ্ধাপরাধীর বিচারকার্য শুরু হয়েছিল, চিকন আলী নামের এক যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায়ও হয়েছিল। অথচ মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়া দাবি করেন, সব যুদ্ধাপরাধীর নাকি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু! পাকিস্তান ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীর এমন বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

২৯ ডিসেম্বর ঢাকা অভিমুখী বিএনপির ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ অভিযাত্রা কর্মসূচীকে ‘নাশকতার পরিকল্পনা’ আখ্যায়িত করে আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সারাদেশে বিরোধী দলের সব ধরনের নাশকতা মোকাবেলা করছে, তখন তিনি (খালেদা জিয়া) ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় ‘নাশকতা চালানোর’ পরিকল্পনা করেছেন। তিনি ঢাকাকে অচল করে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপির কর্মসূচীতে জনগণ সাড়া দেবে না দাবি করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার কোন পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হবে না এবং সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে।

২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগও মাঠে নামতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ মাঠে থাকবে এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় জনগণের সঙ্গে ওই দিন আমরাও থাকব। সেদিন মাঠে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের সকল সংগঠনও মাঠে থাকবে।

বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে মন্তব্য করে প্রবীণ এই পার্লামেন্টারিয়ান আরও বলেন, খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে মার্চ ফর ডেমোক্রেসির কথা বলেছেন। লাঠিহাতে পতাকা নিয়ে আসতেও বললেন। পতাকা বুকে ধারণ করতে পারে। কিন্তু লাঠির সঙ্গে পতাকা নিয়ে আসতে বলে তিনি অগণতান্ত্রিক ও বেআইনী মার্চের কথা বলেছেন। এটা মার্চ ফর ডেমোক্রেসি নয়, মার্চ ফর অটোক্রেসি (স্বৈরতান্ত্রিক), হিপোক্রেসি (ভ-ামী)। এসব না করে বিরোধীদলীয় নেত্রীর উচিত গণতান্ত্রিক আচরণের মধ্যে আসা। আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নির্বাচন থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরানো যাবে না।

অবরোধ-হরতালের পরিবর্তে হঠাৎ করেই কেন বিরোধীদলীয় নেত্রী এমন নতুন কর্মসূচী দিলেনÑ এ নিয়েও রাজনৈতিক মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে গত আড়াই বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এতে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা তো দূরের কথা, দলের নেতাকর্মীদেরই ভালভাবে মাঠে নামাতে পারেনি দলটি। এখন দলের বেশিরভাগ নেতাই আত্মগোপনে। ঢাকা ও সারাদেশে হরতাল বা অবরোধের কর্মসূচীতেও লাপাত্তা দলটির অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতারা। বিরোধীদলীয় নেত্রীর কড়া হুঁশিয়ারির পরও ঢাকার রাজপথে দেখা মেলেনি বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতাকেও।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত ২৬ নবেম্বর থেকে পাঁচ দফায় ২০ দিন অবরোধ কর্মসূচী দিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়লেও সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে নামাতে পারেনি বিরোধী দল। দেশের বিভিন্নস্থানে ব্যাপক নাশকতা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারলেও খোদ রাজধানীতে তার ছিটেফোঁটার প্রভাব ফেলতে পারেনি। কর্মসূচীর নামে বাসে আগুন দিয়ে, মানুষের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে নৃশংস ও ভয়াল কায়দায় হত্যাকা- ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ উল্টো জনমনে বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের সব প্রভাবশালী দেশ ও দাতা সংস্থাও রাজনীতির নামে এমন ভয়াল সহিংসতার নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছেন।

বিএনপির একাধিক সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আর দশ দিন পরেই অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। সরকার যে কোন মূল্যে নির্বাচন করবে। নির্বাচন প্রতিহত করতে খালেদা জিয়ার নির্দেশানুযায়ী একটিও ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করতে পারেনি বিএনপি। বার বার নির্দেশ দিয়েও নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতেও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। শুধু জামায়াত-শিবিরের চোরাগোপ্তা নাশকতার ওপর ভর করে নির্বাচন যে ঠেকানো যাবে না, এটা বুঝতে পেরেই খালেদা জিয়া এখন নিজেই মাঠে নামতে চাইছেন। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, গণতান্ত্রিক কর্মসূচী হলে আত্মগোপন থেকে তাঁরা বেরিয়ে আসতে পারবে, সারাদেশ থেকে লোক এনে ঢাকাকে অচল করার টার্গেট থেকে বিরোধীদলীয় নেত্রী অবরোধ-হরতালের পরিবর্তে নতুন এ কর্মসূচী দিয়েছেন বলেই বিএনপির সূত্রগুলো বলছে।

শাসক দল আওয়ামী লীগও বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপির ডাকা ২৯ ডিসেম্বর ঢাকামুখী কর্মসূচী অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবে দলটি। তবে এ কর্মসূচীতে ব্যাপক নাশকতার আশঙ্কা করছেন দলটির নেতারা। এ কারণে কর্মসূচীর অনুমতি না দিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবে মোকাবেলার জন্য ঢাকায় প্রস্তুত থাকবে দলের নেতাকর্মীরা।

জানা গেছে, ঢাকার আশপাশের সাত জেলার নেতাকর্মীদের এই কর্মসূচী প্রতিহত করতে বিশেষ নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। ঢাকায় প্রবেশের প্রতিটির মোড়ে সতর্ক প্রহরা এবং আশপাশের জেলার নেতাকর্মীরাও সতর্ক অবস্থানে থেকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ঢাকায় ঢুকতে না পারে সে জন্য যা যা করা দরকার তাই করবে। হোফাজতে ইসলামের ৫ মে’র ঘটনা মাথায় রেখে যে কোন মূল্যে এই কর্মসূচী প্রতিহত করারও পরিকল্পনা নিয়েছে শাসক দলটি। দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

শেয়ার করুন