আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের হাত ধরে ক্ষমতায় আসা জাতীয় পার্টির দুই শীর্ষ নেতা দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তার স্ত্রী সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম রওশন এরশাদের সম্পদ বেড়েছে অবিশ্বাস্যহারে। পিছিয়ে নেই দলের প্রেসিডিয়ামের সদস্যসহ অন্য নেতারাও। সংসদে অধিকসংখ্যক আসনের মালিক আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনায় নেতৃত্ব দিলেও তাদের হাতে লাগানো বৃক্ষের ফল ভোগ করেছেন জাপা নেতারা। বিগত পাঁচ বছরে আখের গুছিয়ে নিয়েছেন ইচ্ছামতো। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া জাপা প্রার্থীদের নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় তাদের দেয়া সম্পদের বিবরণ দেখে অনেকের চক্ষুই চড়কগাছ। তবে হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন সব নেতাই। এর বাইরেও তাদের অগাধ সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে।
গত পাঁচ বছরে জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নিট সম্পদ বেড়েছে ৩৫ কোটি ৬৮ লাখ ৩২ হাজার ৭৪২ টাকা। অবশ্য এর মধ্যে তার ওপর নির্ভরশীলের সম্পদও রয়েছে। ইসিতে দেয়া এরশাদের হলফনামা থেকে জানা গেছে, তার বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ৫১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজার ৫৪ টাকা। গত নবম সংসদ নির্বাচনের আগে মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি ৯৩ লাখ ৭ হাজার ৩১২ টাকা। তবে বেসরকারি একটি ব্যাংকের কাছে এরশাদের দায় রয়েছে দুই কোটি ৮৭ লাখ ৮২ হাজার ৫৩৫ টাকা। গত পাঁচ বছরে ব্যক্তিগত আয়ও বেড়েছে এরশাদের। বর্তমানে তার মোট আয় ৯৫ লাখ ৫০ হাজার ৭৪২ টাকা। গত নির্বাচনের আগে যা ছিল ৩৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় এরশাদের তুলনায় স্ত্রী রওশন কয়েকগুণ এগিয়ে গেছেন। গত নির্বাচনের আগে রওশনের এক কোটি ২ লাখ টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স পাঁচ বছরে ফুলে ফেঁপে এখন ২৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওই সময় ৩০ ভরি স্বর্ণের মালিক ছিলেন তিনি। এখন তা ১০০ ভরিতে দাঁড়িয়েছে। ২০০৮ সালে তার বার্ষিক আয় ছিল ৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এখন তা ২ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আগে তার একটি গাড়ি থাকলেও এখন গাড়ির সংখ্যা আরো দুটি বেড়েছে। তার স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে কৃষিজমির পরিমাণ ১ দশমিক ৩১৭৫ একর, দুটি ফ্ল্যাট ও একটি বাড়ি দেখিয়েছেন তিনি।
মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারও গত পাঁচ বছরে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বছরে তিনি আয় করেন এক লাখ ৬২ হাজার টাকা। নগদ অর্থ রয়েছে ৬ কোটি ৬২ লাখ ২৬ হাজার, স্ত্রী জাপার আরেক এমপি নাসরিন জাহান রত্নার কাছে রয়েছে ১১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। বন্ড ও শেয়ার মিলিয়ে আছে ৭ কোটি টাকা, স্ত্রীর নামে আছে দেড় কোটি টাকার বন্ড শেয়ার। তাদের দুটি ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি রয়েছে। ১০০ ভরি স্বর্ণের মালিক তার স্ত্রী। এছাড়া নিজের নামে ৩৩২ শতক ও স্ত্রীর নামে ১৬৫ শতক জমি এবং প্লট ও বাড়ি রয়েছে। এছাড়া পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় ৭ কোটি টাকার একটি হোটেল রয়েছে তার।
জাপার প্রেসিডিয়ামের আরেক সদস্য মজিবুল হক চুন্নুর আয় বেড়েছে প্রায় আট গুণ। কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনের এ এমপির গত নির্বাচনের আগে বার্ষিক আয় ছিল এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। পাঁচ বছরে এখন বেড়ে এক কোটি ৮ লাখ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি ব্যবসা থেকেই বছরে আয় করেন ৯৬ লাখ টাকা। পেশা থেকে আয় করেন আট লাখ টাকা। এমপি হিসেবে তার প্রাপ্ত ভাতা হলফনামায় উল্লেখ করেননি। ২০০৮ সালে তার অস্থাবর সম্পত্তি ছিল ৪৪ লাখ টাকার। আর স্ত্রীর ছিল ১৯ লাখ টাকার। স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে টঙ্গীতে স্ত্রীর নামে ৫ কাঠার একটি জমি আর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বাড়ির একটি অংশের কথা উল্লেখ করেন তিনি। বর্তমানে তার সম্পত্তি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে নগদ ৩৭ লাখ টাকা রয়েছে। আর স্ত্রীর অস্থাবর সম্পত্তি ৪ গুণ বেড়ে ৭৯ লাখ ও স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ লাখ টাকায়। অবশ্য এর বাইরেও ঢাকা ও গ্রামের বাড়িতে অঢেল সম্পদ রয়েছে তার।
গত পাঁচ বছরে ১০ গুণ সম্পদ বেড়েছে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নির্বাচনকালীন সরকারের পানি সম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের। প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। হলফনামায় তিনি ১ কোটি ৩২ লাখ টাকার অ্যাপার্টমেন্ট, ৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকার কৃষিজমি, নিজের ও স্ত্রীর নামে ১৯ কোটি টাকার জমি, নিজের ২৪ লাখ ৬৭ হাজার ও স্ত্রীর নামে ৫৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকার বেশি ব্যাংকে জমা আছে দেখিয়েছেন। এছাড়া বন্ড, ঋণপত্র ও শেয়ার আছে ১১ কোটি ১৯ লাখ টাকার বেশি, স্ত্রীর নামে আছে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৮০ হাজার ৬০০ টাকা। নগদ অর্থ রয়েছে ৯ লাখ ১৬ হাজার, স্ত্রীর আছে ৬৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা। বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ৩২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। ২০০৮ সালে তার স্থাবর সম্পত্তি ছিল এক কোটি ৬৫ লাখ ও অস্থাবর সম্পত্তি ছিল ৪১ লাখ টাকার মতো। স্ত্রীর অস্থাবর সম্পত্তি ছিল ৪৭ লাখ ও স্থাবর সম্পত্তি ছিল ৪ লাখ টাকা।
অর্থ-সম্পদের অভাব নেই প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদেরও। রাজধানীতে ২০টি প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। বছরে কৃষি খাতে আয় করেন ৪০ হাজার, বাড়িসহ অন্যান্য ভাড়া সাড়ে ৬ লাখ, ব্যবসা থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার এবং মৎস্য খামার থেকে আয় করেন ১৫ লাখ টাকা। নগদ টাকা আছে ৮ লাখ ৪৩ হাজার ও স্ত্রীর নামে আছে ৯১ লাখ টাকার বেশি। ব্যাংকে জমা ২৫ লাখ ও স্ত্রীর নামে আছে ৩৫ লাখ টাকা। শেয়ার বন্ড ও ঋণপত্র আছে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। সাভারে রয়েছে বাগানবাড়ি। বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে ২০টি।
আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য তাজুল ইসলাম চৌধুরীর বছরে আয় ৬০ হাজার টাকা। শিক্ষকতা-চিকিৎসা ও আইন পেশায় বছরে আয় ২ লাখ ৩১ হাজার। ব্যাংক মুনাফা পান ২ লাখ ৭১ হাজার টাকার বেশি। নগদ অর্থ আছে ২৬ লাখ টাকা। ব্যাংকে জমা ২ লাখ টাকার বেশি। আছে গাড়িসহ অন্যান্য আসবাবপত্র ও ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী। কৃষিজমি ৭ একর অকৃষি জমি ৭ শতক। রয়েছে পৈত্রিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট।
প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফা জামাল হায়দারের পেশাগত আয় ৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। দোকান ভাড়া পান ১ লাখ ৩৯ হাজার টাকার বেশি। স্ত্রীর নামে ব্যাংকে আছে ৫০ হাজার টাকা ও ১৫ ভরি স্বর্ণ।
প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. সোলায়মান আলম শেঠের বার্ষিক আয় ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। নগদ অর্থ আছে ৮ লাখ টাকা।
জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর ফার্মের বার্ষিক আয় ৮২ লাখ ৫০০ টাকা। বাড়ি ভাড়া থেকে বছরে পান ১১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। নগদ অর্থ ২৬ লাখ ১৬ হাজার টাকার বেশি, ব্যাংকে জমা ১০ লাখ, আছে ৩৭ লাখ টাকার শেয়ার। দুটি ফ্ল্যাট ও ১১ কাঠার বেশি জমি রয়েছে তার।
প্রেসিডিয়াম সদস্য সালমা ইসলাম বছরে বাড়িভাড়া পান ৩৫ লাখ টাকা। ব্যাংকে আছে ৪৫ লাখ টাকার বেশি। শেয়ার-বন্ডসহ ঋণপত্র কিনেছেন ১৭ কোটি ২২ লাখ টাকার বেশি। স্বর্ণ আছে ৪০ লাখ টাকার। কৃষিজমি আছে প্রায় ৫ কোটি টাকার। এছাড়া ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকার বেশি মূল্যের ভবন রয়েছে তার।
প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসিম ওসমান বছরে ৫৮ হাজার টাকার বেশি ব্যাংক সুদ পান। নিজ নামে ব্যাংকে আছে ২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে আছে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। নগদ টাকার পরিমাণ সাড়ে ১৩ লাখ ও স্ত্রীর আছে ১ লাখ টাকা।