নির্বাচন প্রতিহতের ডাক দিয়ে বিএনপির ঢাকামুখী অভিযাত্রাকে আপাতদৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে ওই কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত কতটুকু শান্তিপূর্ণ থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনেরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতির অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কারণ, এর আগেও এ রকম কর্মসূচিতে বাধা এসেছে। আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে রাজনীতি শান্তিপূর্ণ গণ্ডির মধ্যে রাখা সম্ভব হবে না বলেই মনে করেছন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে অপরাজনীতির কারণে। এজন্য অভিযাত্রা কর্মসূচি গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কতটুকু নিশ্চিত করবে, তা নিয়েও সংশয় কাটছে না।
বিএনপির ঢাকা অভিযাত্রা সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিরোধী দলের ক্রমাগত হরতাল আর অবরোধে জনজীবন বিপর্যস্ত। জনগণ এখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। এ অবস্থায় ঢাকামুখী অভিযাত্রা কর্মসূচি দিয়ে খালেদা জিয়া আন্দোলন কর্মসূচিতে একটা বিশেষত্ব এনেছেন ঠিকই কিন্তু তা অহিংস হলেই জনগণের সমর্থন পাওয়া সম্ভব। তবে এ ধরনের কর্মসূচির সফলতা নির্ভর করে দলের সাংগঠনিক শক্তির ওপর।’
কর্মসূচিকে সময়োপযোগী মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কর্মসূচিতে সরকারের বাধা দেওয়া উচিত হবে না। তবে অভিযাত্রার পরিণতির ওপর নির্ভর করবে এর কার্যকারিতা।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ধারাবাহিক অবরোধ কর্মসূচিতে মানুষ বন্দী হয়ে গিয়েছিল। নতুন এ কর্মসূচি জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দেবে। ঢাকামুখী অভিযাত্রা সহিংসতায় রূপ নিলে তা জনগণের জন্য আবার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অন্তত সামনে কয়েক দিন হরতাল-অবরোধ হবে না। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি নামটা বেশ দৃষ্টি আকর্ষণীয়। এতে চমৎকারিত্ব আছে। অনেকটা লংমার্চের ঢঙে সাজানো হয়েছে এর নামকরণ।’
তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র কেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটি একটু পর্যলোচনা করলে একাধিক কারণ সামনে এসে দাঁড়াবে। এরশাদ পতনের পরে আকাক্সক্ষা ছিল যে গণতন্ত্র ফিরে আসবে। তিন জোটের রূপরেখায় এমন একটি অঙ্গীকার করা হয়েছিল। কিন্তু ’৯১ থেকে আজ অবধি আমরা গণতন্ত্র থেকে ক্রমান্বয়ে পিছু হটছি। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই কোনো না কোনো সংশয় তৈরি হচ্ছে। আর এবার তো নজিরবিহীন সংকট।’
সৈয়দ আনোয়ার বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি মনে হলেও পরক্ষণেই তা মনে হচ্ছে না। কারণ, চলমান রাজনৈতিক অবস্থায় সহিংসতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
‘তবে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা আসবে না বলা হলেও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তো রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করে না, ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই কাজ করে থাকে। সুতরাং কর্মসূচিতে যে উসকানি থাকবে না, তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না’Ñ মন্তব্য করেন আনোয়ার হোসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘সমঝোতা এখনো সম্ভব। বিরোধীদলীয় নেত্রী সেটা মোটামুটিভাবে পরিষ্কার করেছেন। বিএনপি এখনো আলোচনায় বসতে রাজি। এটা পজিটিভ।’
তিনি বলেন, ‘বিরোধী দলে যে রাজনৈতিক দলই থাক, তারা গণতন্ত্রের জন্য যুক্তিসংগত কথা বলেন। আবার ক্ষমতায় গেলে চিত্র পাল্টে যায়। এখন ২৯ ডিসেম্বর গণজমায়েতের চাপে পড়ে সরকার যদি মনে করে আলোচনায় বসি, তাহলে ভালো।’
গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘খালেদা জিয়া যে দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছেন, তাতে অনেক কিছু উঠে এসেছে। ভাষণে তিনি ’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে তার আন্তরিকতার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন পঞ্চদশ সংশোধনী-পরবর্তী আন্দোলনের কথা। এজন্য সরকারের উচিত ছিল আলোচনা করে একটি সমঝোতায় আসা। কিন্তু সেটি হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কারণ এর আগে যখন বিরোধী দল সমাবেশ ডেকেছিল তখন তাদের বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে লঞ্চ, বাস, ট্রেন, ফেরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ২৯ ডিসেম্বর যদি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে রাজনীতি আর শান্তিপূর্ণ গ-ির মধ্যে থাকবে না। কারণ, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হলে অনিয়মতান্ত্রিক পন্থা উৎসাহিত হয়।’
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘এবার খালেদা জিয়ার ভাষণ অনেক সংযত। তাতে তিনি নমনীয় আন্দোলনের কর্মসূচি যেমন ঘোষণা করেছেন, তেমনি আলোচনার প্রস্তাবও রেখেছেন। সমঝোতার জন্য তার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। এখন সরকারের দিক থেকেও এ ব্যাপারে বক্তব্য আসতে হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিরোধী দল হরতাল-অবরোধ থেকে বেরিয়ে এসে গণজমায়েত করে শান্তিপূর্ণভাবে যদি কর্মসূচি পালন কওে, তাহলে ভালো। এটা শুভ লক্ষণ। একই সঙ্গে সরকার যাতে উসকানি না দেয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, রাজপথে সমস্যার সমাধান হয় না। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। দুই দলকেই বাস্তববাদী হয়ে সদিচ্ছার পরিচয় দিতে হবে।’