মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসিকে ‘বিচারিত হত্যা’ বলেছেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান। ফাঁসির ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে গতকাল পাকিস্তানের পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবে এবং চতুরতার সঙ্গে পাক পার্লামেন্ট মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানী সেনা ও তাদের দোসর এদেশের রাজাকাররা যে ৩০ লাখ নিরীহ বাঙ্গালীকে নির্মমভাবে হত্যা এবং দুই লাখ মা-বোনকে ধর্ষণের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা যে বাঙ্গালীদের মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করেছিলো পাক পার্লামেন্ট সেই বিষয়টি আরেকবার প্রমাণ করলো।
কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় বানচালে দেশের বিভিন্ন শহরে জামায়াত ব্যাপক অরাজকতা তৈরি করেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কাদের মোল্লা ছিলেন কুখ্যাত রাজাকার এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একনিষ্ঠ দোসর। বৃহস্পতিবার কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পরে পাকিস্তান জামায়াত তাকে ‘শহীদ’ আখ্যায়িত করে সেদেশে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভকারীদের প্লাকার্ডে উর্দুতে লেখা ছিলো- ‘বাংলাদেশ মে জামায়াত-ই-ইসলামী মুজরিম কিউ’। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী কেনো ষড়যন্ত্রের শিকার?’
পাকিস্তান জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাই দাবি করেছিলো কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে কাদের মোল্লার ফাঁসি স্থগিত করা হোক। এই দাবির অংশ হিসেবে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান চতুর্থবারের মতো সংসদে তার ‘গভীর ক্ষোভ’ ব্যক্ত করলেন। খান বলেন, ‘বাংলাদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত এক ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের একজন একনিষ্ট সমর্থক ছিলেন কাদের মোল্লা। তার মৃত্যুতে প্রতিটি পাকিস্তানি শোকার্ত ও মর্মাহত।’
পাকিস্তান জামায়াতের এই নেতা তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর করা নামমাত্র এক আইনের কথা স্মরণ করে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কোনো ব্যক্তির অবস্থানের কারণে তাকে পরবর্তীতে শাস্তি বা মৃত্যুদ- দেয়া যাবে না। তবে এটি একটি মিথ্যা বিবৃতি।
এরই অংশ হিসেবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইডে ‘বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতা’র কথা প্রকাশ করেছে এবং কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের নিন্দা জানিয়েছেন।
কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের পর থেকে পাকিস্তানের এসব কার্যকলাপে মনে হয় বাংলাদেশ এখনো পরাধীন রয়েছে। পাকিস্তানীরা যেনো ভুলে গিয়েছে যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারা আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে ১৯৭১ সাল থেকেই বিরোধীতা করে আসছে পাকিস্তান। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা ছেড়ে দেন জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। সেসময়ে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে ভুট্টো ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে প্রথম বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে ভুট্টো বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে। এমনকি সেসময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে তারা ‘ঢাকা কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তবুও বাংলাদেশের নামটি উচ্চারণ করেননি।
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাধ্য হয়েই বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান। যেহেতু সে বছরে লাহোরে ইসলামিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তবে ওই বছরের শেষে চীনাপন্থী কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে পরিচিত আবদুল হক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সরকার উৎখাতের জন্যে সহায়তা চান। আবদুল হকের আবেদনে সাড়া দিয়ে ভুট্টো তার মন্ত্রিসভায় সকল ধরনের সহযোগিতার নির্দেশ দেন। স্ট্যানলি ওলপার্টের রচিত ‘জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান’ শীর্ষক বই থেকে উপরোক্ত অংশটি সংগৃহিত।
১৯৭৪ সালে বাধ্য হয়ে এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুট্টো জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। তবে তার ব্যবহারে শহীদদের প্রতি চরম বিরক্তি এবং অপমান প্রকাশ পায়। তিনি মাও ক্যাপ খুলতে অস্বীকৃতি জানান এবং তার সামনে পরিদর্শক বই উপস্থাপন করা হলে তিনি ‘যথেষ্ট তামাশা হয়েছে’ হয়েছে বইটি ঢেলে সরিয়ে দেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে এই খবর শুনে তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী এটিকে ‘শুভ সংবাদ’ বলেন। এমনকি শীঘ্রই বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে বলে জানান।
১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের তৃতীয় সেনা শাসক বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধে আসেন। সেসময়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা তার কাছে অভিব্যক্তি জানতে চাইলে, রহস্য করে তিনি বলেন-‘আপনাদের মুক্তিযোদ্ধারা তো আমাদেরই মুক্তিযোদ্ধা’।
১৯৭১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো পাকিস্তান সরকারই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখায়নি বা তাদের পূর্বপুরুষদের এধরনের ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা চায়নি। এমনকি পাকিস্তানের চতুর্থ সেনা শাসক পারভেজ মোশাররফ বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের মতো আর কাউকে ক্ষমা করা হবে না।’
১৯৭৪ সালের এপ্রিলে দিল্লিতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান এই তিন দেশের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে পাকিস্তানে আটকে পড়া সব বাঙালি বাংলাদেশে ফিরে আসতে চায়। এপর পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিরা সেই সুযোগ পায় এবং তারা বাংলাদেশে ফিরে আসে। একইভাবে ভারতে আটকে পড়া পাকিস্তানিরা তাদের দেশে ফিরে যায়। সেসময়ে ১৯৫ জন পাক সেনা কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশ সরকার। তবে ভুট্টো সরকার সুকৌশলে সেই সব সেনা কর্মকর্তাকে ছেড়ে দিতে বলেন এবং আরও বলেন তাদের আমাদের দেশে নিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। ভুট্টোর কথায় আশ্বস্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু তাদের ছেড়ে দিলেও কথা রাখেনি পাক সরকার।
আজও একইভাবে পাকিস্তান সরকার তাদের পার্লামেন্টে এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ে নিন্দা জানিয়ে আসছে। কিন্তু এখনো বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চুপ ভূমিকায়। পাকিস্তান কৃর্তপক্ষের এসব ভূমিকার পরেও বাংলাদেশ সরকারের কোনো প্রতিবাদ নেই। পাকিস্তান দূতাবাসের কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে এখনো তাদের এইসব কাজের জন্যে বাংলাদেশ সরকার তলব করেনি। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পরে পাকিস্তান জামায়াত প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত চুপ করে থাকাটা মেনে নিলেও, এখনো কেনো বাংলাদেশ সরকার নিশ্চুপ ভূমিকায় সেটি বোঝা যাচ্ছে না। বিষয়টি যেহেতু সেদেশের পার্লামেন্টে উত্থাপিত হয়েছে, তাহলে তো বাংলাদেশ সরকারও পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী কি জাতিকে তার নিশ্চুপ ভূমিকার কারণ পরিষ্কার করবেন?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে পাকিস্তানের ভূমিকা কেনো এমন, বিষয়টি জাতিকে পরিষ্কার করবেন?