আপনি সংসদ সদস্য হতে চান না। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন আপনাকে সংসদ সদস্য বানাবেনই। অন্তত সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং জিএম কাদেরের বেলায় নিশ্চিতভাবেই এ ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় পার্টির আরেক নেতা কাজী ফিরোজ রশীদের ঘটনা আরও নাটকীয়। শুক্রবার তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার কবুল করেন ঢাকার রিটার্নিং অফিসার। একদিন পর তাকে লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে রসিকতার এ বিশ্ব রেকর্ডের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদকে অভিবাদন। অবশ্য এখন অভিবাদন দেয়ারও সময় নয়। চাইলেই আপনি সবাইকে অভিবাদন জানাতে পারবেন না। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ এখন ডরে-ভয়ে কাঁপছে। পৃথিবীতে এমন নির্বাচন কবে, কোথায়, কে দেখেছেন? ভোটের আগেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে গেছেন। সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান খুব যুতসইভাবে চিত্রিত করেছেন একে। তিনি বলেছেন এ যেন সমঝোতার ভিত্তিতে টেন্ডার ভাগাভাগির মতো। এ ভাগাভাগিতে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ পেয়েছে ১২৭, জাতীয় পার্টি (জাপা) ২১, জাসদ ৩, ওয়ার্কার্স পার্টি ২ এবং জেপি ১ আসন। ভোটের আগেই ভোটে জয়ী হওয়ার অতীত রেকর্ডে চোখ বুলিয়ে নেয়া যেতে পারে। ১৯৭৩ সালে ১১, ১৯৭৯ সালে ১১, ১৯৮৮ সালে ১৮, ১৯৯৬ সালে ৪৯ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের রেকর্ড ছিল। কিন্তু এবারের সাজানো নাটকে চমৎকার অভিনয় করছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। এই কমিশনের নাটকের অবশ্য শুরু হয়েছিল বিএনএফ নামে একটি দলকে নিয়ে। যে দলের নাম বাংলাদেশের কোন মানুষ আগে শোনেনি। হঠাৎ সে দলকে নিবন্ধন দিতে জিহাদ ঘোষণা করে রকিব কমিশন। কারও সমালোচনাই তারা আমলে নেয়নি। তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে চলতি কার্যক্রমে অতীতের সব রেকর্ডই ভেঙে দিয়েছে কমিশন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চিঠি দিয়ে কমিশনকে জানান, তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। জাতীয় পার্টির কোন প্রার্থীকে যেন লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ দেয়া না হয়। কিন্তু প্রার্থীপ্রেমী নির্বাচন কমিশন এরশাদের চিঠি আমলে নেয়নি। তারা জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ দেন। তবে এর চেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে জাতীয় পার্টির প্রায় ১০০ প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেও নির্বাচন কমিশন এ প্রত্যাহারও মেনে নেয়নি। মনোনয়ন প্রত্যাহার করা প্রার্থীদেরও রিটার্নিং কর্মকর্তারা প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছেন। যদিও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের নাটক এখনই শেষ হচ্ছে না। আরও কিছু আসনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ঘোষণা করা হতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশনের এ ক্যারিশমা দেখে দু’টি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সমঝোতার ভিত্তিতে আসন ভাগাভাগির কথা বলেছেন। বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নিতো তাহলে বিএনপিকেও কি এভাবে আসন দেয়া হতো। সর্বদলীয় সরকারে যেভাবে তাদের মন্ত্রিত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছেÑ দশম সংসদ নির্বাচনে কতটি আসন দেয়া হতো বিএনপিকে। কোন সূত্রই অবশ্য তা নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে জাতীয় পার্টি গত নির্বাচনে যত আসন পেয়েছে এবং এবার তাদের যত আসন দেয়া হয়েছে তাতে অনুমান করা যায় ৩০-এর এদিক-সেদিক আসন বিএনপিকে হয়তো দেয়া হতো। জামায়াত যেহেতু নির্বাচনী রাজনীতিতে অবৈধ সে কারণে জামায়াতকে কোন আসন দেয়া হতো না। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যেতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অনড় অবস্থানের যৌক্তিকতার বিষয়টিও আবার সামনে এসেছে। যদিও বিএনপির একটি অংশ শেখ হাসিনা আর বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেও নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল। বহুদিন ধরে বলা হতো, বাঙালি জাতি সমঝোতা করতে জানে না। কিন্তু নির্বাচনের আগেই আসন ভাগাভাগির সমঝোতা করে আমরা প্রমাণ করেছি বাঙালি সমঝোতা করতে সক্ষম। এমনকি ভোটের আগেই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেছে একটি জোট। একেই বলে জাতীয় রসিকতা।