একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি এবং তদন্ত সংস্থার সদস্যদের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন কেনা এবং চাওয়া অনৈতিক। একারণে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ও তদন্ত সংস্থায় সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে দেখা দিয়েছে বিচার নিয়ে নানান প্রশ্ন।
সূত্র জানায়, তাদের মনোনয়ন কেনা নিয়ে আলোচনা- সমালোচনার ঝড় বইছে পক্ষে-বিপক্ষে। নির্বাচনে ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আবারো শুরু হয়েছে কোন্দল।
যদিও তারা এর আগে থেকেই ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি, তদন্ত কর্মকর্তা ও কৌঁসুলিদের নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত স্কাইপি কেলেংঙ্কারীর পরে শুধুমাত্র একজন বিচারপতি পদত্যাগ করেছিলেন। তবে তাদের সমালোচনায় কোনো ধরণের কর্ণপাত করেনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, সরকার মানবতাবিরোধী অপরোধের বিচার করার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করেনি। সরকার নিজ দলীয় কর্মীদের নিয়োগ দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য নয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপি-জামায়াত নিধন করার জন্য।
সূত্রে জানায়, ট্রাইব্যুনালের বিচারের সাথে সংশ্লিষ্ট ১০ জন সরকারি দল আওয়মী লীগের মনোনয়ন কিনেছেন। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা ছাত্রজীবনে বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলেন। পরে পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। তবে তদন্ত কর্মকর্তারা পুলিশ বহিনীতে দ্বায়িত্ব পালন করার পরে অবসরে গিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়।
একারণে তাদের দ্বারা যে বিচার পরিচালিত হচ্ছে তা সঠিক নয় বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম বলেন, আমার মতামত নোট করা যাবে না। তুরিন আফরোজ বলেন, আমি মনে করি যদি কেউ দ্বায়িত্ব নিয়ে দেশের সেবা করতে চায় তাহলে তারা ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এখানে থেকে নির্বাচন করারটা সঠিক মনে হচ্ছে না।
আসামিপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, বিধান আছে সরকারের অনুমতি নিতে হয়।যদি কোনো কর্মকর্তা একটি আদালতের কৌঁসুলির দ্বায়িত্ব পালনের সাথে কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন(নমিনেশন) নেয় তহলে বুঝতে হবে তাদের রাজনৈতিক দলের আনুগত্য আছে।
তিনি বলেন, আমি জানি তারা সরকারি কাজ করছেন, সরকারি বিধান হলো তারা পূর্ণকালীন কর্মচারীর কাজ করতে হবে।তবে যদি পৈত্রিক (সম্পত্তি) বিজনেস হলে সেটা ভিন্ন কথা।
বিশিষ্ট আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক বলেন, এমনিতে ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচারপতি ও বিচার কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে আরেকটি সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন।
তবে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মনে করেন, এতে বিচার নিয়ে বিতর্ক হওয়ার কিছু নেই। বিচার করবেন বিচারক, আইনজীবী নন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের চারজন কৌসুলি ও তদন্ত সংস্থার তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নপত্র কিনেছেন। এপর্যন্ত সাতজন মনোনয়ন কিনেছেন। কমপক্ষে আরও দুজন মনোনয়পত্র কিনবেন বলে সূত্র জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামীলীগ পন্থী বেশ কয়েক জন আইনজীবী প্রশ্ন তুলেছেন, যে শুধুমাত্র দলীয় পরিচয়ে অযোগ্য-অপদার্থরা ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হিসেবে দ্বায়িত্ব পেয়েছে। আর এখন আবার তারা এমপি হওয়ার জন্য মরিয়া হয়েগেছে। তারা বলছেন, এমন দলীয় কর্মী দিয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচার করলে বিচার নিয়ে প্রশ্ন তো উঠবেই।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র বিক্রির প্রথম দিনে তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক মো. আবদুল হান্নান খান নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা) আসন, সংস্থাটির জেষ্ঠ কর্মকর্তা এম সানাউল হক কিশোরগঞ্জ-৩ (তাড়াইল-করিমগঞ্জ) এবং অপর কর্মকর্তা আবদুর রহিম ময়মনসিংহ-৮ ইশ্বরগঞ্জ আসনের জন্য মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল হান্নান খান ২০০৮ সালে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন। তবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে তিনি নেত্রকোনা-৫ আসন থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে ১৮ হাজার ভোট পেয়ে পরাজিত হন।
গত ২০০০ সালে ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি পদ থেকে তিনি অবসরে গেলেও ২০১১ সালে তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে তদন্ত সংস্থার প্রধান হিসেবে নিয়েগ দেয়া হয়। অপরা কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম তিনি ডিআইজি পদ মর্যাদায় ট্রাইব্যুনালে তদন্ত সংস্থায় কাজ করছেন। ৬৯ এ ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
একই দিনে রাষ্ট্রপক্ষের রাষ্ট্রপক্ষের পাঁচ জন কৌঁসুলি মনোনয়নপত্র কিনেছেন এবং গত বৃহস্পতিবার কৌঁসুলি অ্যাডেভাকেট মোহাম্মদ আলী ঢাকা-২০ (ধামরাই) আসনের জন্য মনোনয়ন কিনেছেন।ওই দিনই রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ সীমন শরীয়তপুর-২ (নডড়িয়া-সখীপুর) আসন, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মোখলেছুর রহমান বাদল কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনে, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট নূরজাহান বেগম মুক্তা চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি) আসনে এবং রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন হবিগঞ্জ-৪ (চুনারঘাট-মাধবপুর) আসনের জন্য মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
অপরদিকে পালতক ও ট্রাইব্যুনালের বিচারে অনুপস্থিত জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা হাইটুনি মুন্সিগঞ্জ-৩ গজারিয়া আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী।
বাংলাদেশ কৃষক লীগের সাবেক সহসভাপতি কৌঁসুলি মোহাম্মদ আলী বর্তমানে আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধ লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। নড়িয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি পরাজিত হন।
আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মোকলেছুর রহমান বাদল পাকুন্দিয়া আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তিনি ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট নূরজাহান মুক্তা বর্তমানে মহিলা আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন। অপরদিকে সালামা হাই টুনির নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয়ের সাথে সাথে বাবার পরিচিতির সুবাধে তিনি তার মনোনয়ন পেতে পারেন বলে জানান। তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষকলীগের সম্পাদিকা, ঢাকাবারের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পদিকা, সুপ্রিমকোর্ট আওয়ামী আইনজীবী প্রচার সম্পাদক, মুন্সিগঞ্জ জেলা আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রক কমিটির সদস্য এবং সুপ্রিমকোর্ট আওয়ামী মহিলা আইনজীবীদের সেক্রেটারি।
ট্রাইব্যুনালের সব কৌঁসুলি এবং কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন পেলে তারা ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করবেন।
তবে সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি এবং তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কিনে সংসদ নির্বাচন করলে সমালোচনার মুখে পড়বেন কিনা জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড.শাহদীন মালিক বলেন, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা ও কৌঁসুলিদের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়া সম্পূর্ণ অনৈতিক।
তিনি বলেন, অনেক চড়াই-উতড়াই পার হয়ে প্রায় চার বছর পর এই বিচার-প্রক্রিয়াটি আজ একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এখন সরকারি দলের মনোনয়ন চাওয়ার কারণে বিরোধীপক্ষের কাছে এ বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আরেকটি যুক্তি তুলে দেওয়া হবে। এই মনোনয়নপত্র কেনাকে অজুহাত বানিয়ে তারা বিচার-প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করবে।
আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ এ বিষয়ে ভিন্নমত দিয়ে বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলিরা রাষ্ট্রের কর্মচারী নন। ট্রাইব্যুনালের বাইরেও তারা মামলা পরিচালনা করতে পারেন।
তিনি বলেন, সংসদ প্রণীত আইন অনুসারে বিচার হবে, বিচার করবেন বিচারকেরা। আইনজীবীদের বিভিন্ন মতাদর্শ থাকতে পারে, এতে বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, এ ধারণা সঠিক না।