প্রধান সমুদ্রবন্দর নগরী হওয়ার কারণে অর্থনীতি তো বটেই, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক দিয়ে রাজধানীর পর চট্টগ্রামের অবস্থান। যে দলের কর্মসূচিই হোক না কেন, এ কারণে আন্দোলন-সংগ্রামেও চট্টগ্রামের ‘রেটিং’ বিবেচনায় নেয়া হয়।
১৮ দলের চলমান নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিএনপি হাই কমান্ডের কাছে রাজধানীর হতাশাব্যঞ্জক চিত্রের বিপরীতে চট্টগ্রামের অবস্থান কিছুটা আশার সঞ্চার করেছিল।
বৃহস্পতিবার দুইজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার গ্রেফতার আর প্রথম সারির প্রায় সব নেতাসহ মাঝারি ও মাঠপর্যায়ের দুই সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করেছে। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে বিএনপির নেতাকর্মীদের হতাশা, ক্ষোভ আর উদ্বেগ বাড়ছে।
গত তিন দিনের অবরোধে বন্দরের নিমতলা এলাকায় বিএনপি কর্মীদের অ্যাকশন, ওয়াসা মোড়ে সমাবেশ পণ্ড করাকে নিয়ে সংঘর্ষ, সিটি গেইট এলাকায় বুধবার পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী পুলিশ-র্যাবের সঙ্গে তুমুল প্রতিরোধের ঘটনায় পুরো বন্দরনগরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এ ঘটনায় আন্দোলনের ব্যাপ্তি আরো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় কপালে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠে পুলিশ, নির্বাচন কমিশন , সিভিল প্রশাসন আর ক্ষমতাসীন দলের। সিদ্ধান্ত হয় হার্ডলাইনে যাবার।
এ সিদ্ধান্তের আলোকেই মূলত বুধবার রাতে নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনের বাসায়-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালায় পুলিশ। অধিকাংশ নেতা নিজ বাসাবাড়ি অন্যত্র রাত যাপন শুরু করেন। আর বুধবার বিকেলেই আমির খসরু চলে যান রাজধানীতে।
নগরীর পাঁ থানায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন ঘটনায় নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খন্দকার, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, নগর জামায়াতের আমির মওলানা শামসুল ইসলাম এমপিসহ প্রায় দুই সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযানে নামে পুলিশ।
নগর বিএনপির নাসিমন ভবনস্থ কার্যালয়ের সামনে বুধবার মিছিলের সময় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খন্দকারকে অপর ছয় নেতাসহ গ্রেফতার করা হয়। সারাদিন ভর আর কোনো নেতাকে মাঠে দেখা যায়নি। গ্রেফতার অভিযান শুরুর পর থেকে সবাই মাঠ থেকে তারা সাময়িক প্রস্থান করেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বিমানে করে ঢাকা প্রস্থানের প্রাক্কালে পুলিশ তাকেও আটক করে।
দলীয় পর্যায়ে আমীর খসরু ও মীর নাছিরের ঢাকা যাত্রাকে মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয়ার চেষ্টা-তদবির করার উদ্যোগ বলে প্রচার করা হলেও মাঠ নেতা-কর্মীদের ফিসফিসানি থেমে নেই। সেখানে উগড়ে পড়ছে ক্ষোভ। ভিআইপি টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আলাপরত কয়েকজন যুবদল কর্মীকে বলতে শোনা যায়, “মূলত জামিন-টামিন নয়, তারা আন্দোলন থেকে পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের সরিয়ে রাখতে রাজধানী পাড়ি জমাতে শুরু করছেন। কারণ, সেখানে বেশ সুবিধা। অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের মতো উধাও হয়ে থাকতে পারবেন। কর্মীদের চাপ থেকে অনেকটা মুক্ত থাকা যাবে।”
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে ১৮ দল বিশেষ করে বিএনপির রাজনীতিতে দৃশ্যত কোন্দল, মান-অভিমান ভুলে আবদুল্লাহ আল নোমান, খসরু, মীর নাছির, আকবর খন্দকার এক কাতারে দাঁড়িয়ে আন্দোলন-হরতাল সফলে একসাথে মাঠে কাজ করেছেন। এর ফলাফলও পড়ে মাঠ পর্যায়ে। রাজধানী যেখানে নিরব, নিথর, আন্দোলন জমানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ৮ ‘সেনাপতি’ জুবুথুবু হয়ে অনেকটা লাপাত্তা, সেখানে চট্টগ্রাম ক্ষণে ক্ষণে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। সারা দেশের আন্দোলনের ‘হট স্পটে’ পরিণত হওয়া সীতাকুণ্ড- মীরসরাইয়ের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অচল হয়ে পড়ায় বন্দর, কাস্টমস কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে।
কিন্তু বৃহস্পতিবারের পর থেকে দৃশ্যপট হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করেছে। কোনোরকম পিকেটিং ছাড়াই অবরোধ সফল হতে থাকলেও নেতারা গা ঢাকা দেয়ায় কর্মীদের মনে হতাশা-উদ্বেগ বাড়ছে।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক এক বিএনপি নেতা জানান, গোলাম আকবর খন্দকার, মীর নাছিরের মতো প্রথম সারির নেতা গ্রেফতার হওয়ার পরও মহানগরীর কোথাও কোনো প্রতিবাদ, বিক্ষোভ মিছিল বের হয়নি। দেয়া হয়নি হরতালের মতো কোনো কর্মসূচিও। এ ঘটনায় সাধারণ নেতা-কর্মী-সমর্থকরা স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ।
এ বিএনপি নেতা জানান, “নোমান ভাই ও কিছু নেতা ছাড়া সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এক গ্রুপকে মামলা হয়রানিমুক্ত রাখা সরকারি দল ও প্রশাসনের কৌশল নাকি বোঝাপড়ার ফসল-এ নিয়েও নানা কথাবার্তায় পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়ছে । এমতাবস্থায়, আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা সত্যিই উদ্বিগ্ন।”
গোলাম আকবরের গ্রেফতারের পর প্রায় শ’খানেক নেতাকর্মী কোতোয়ালী থানা বাইরে ভিড় জমায়। কখন নেতাকে কোর্টে নেয়া হবে সে অপেক্ষায় তাদের অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু কোথাও একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়নি। নগরে কিছু না হলেও মীর নাছিরকে গ্রেফতারের পর হাটহাজারীতে মিছিল বের করে চারটি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করেছে বিএনপি কর্মীরা ।
এ দিকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে কল করার পরও বৃহস্পতিবার থেকে আবদুল্লাহ আল নোমান, আমীর খসরু, ডা. শাহাদাত, গ্রেফতার হবার পূর্ব পর্যন্ত মীর নাছির, এসব নেতার ব্যাক্তিগত সহকারীর মুঠোফোন, এমনটি মাঝারি সারির নেতাদের মুঠোফোন পর্যন্ত হয় বন্ধ, নয়তো অবিরাম ব্যস্ত পাওয়া গেছে।
শুধু মুঠোফোনে পাওয়া গেছে নগর ছাত্রদলের সভাপতি গাজী সিরাজ উল্লাহকে। তিনি জানান, “কেন্দ্রীয় কর্মসূচি মোতাবেক গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বাদ জুমা জমিয়তুল ফালাহ ময়দানে। সেখানে যাই ঘটুক, নোমান ভাইসহ আমরা উপস্থিত হবো। আর বিকালে দলীয় কার্যালয়ের সামনে গোলাম আকবর-মীর নাছিরকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত হবে বিক্ষোভ সমাবেশ।”