সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচার মামলার দায় থেকে সম্প্রতি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের খালাস পাওয়ার বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বিচারাঙ্গনে এখন বেশ আলোচিত প্রসঙ্গ। এর কারণ এ মামলার আসামি তারেক রহমান দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক পরিবারের একজন সদস্য, যিনি নিজেও রাজনীতির শীর্ষ পদে আছেন। এরই মধ্যে এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রস্তুত করেছেন ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. মোতাহার হোসেন। বিচারক মামলার নথি পর্যালোচনা করে যে রায় দিয়েছেন তার কিছু অংশ প্রকাশ করা হলো।
বিচারক মামলার রায়ে উল্লেখ করেছেন, এজাহার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে জানুয়ারি ২০০৩ সাল থেকে মে ২০০৭ সাল। মামলা দায়ের হয়েছে ২৬/১০/০৯ ইং তারিখে। এ মামলায় আসামিদ্বয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনকালে ঘটনার তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ০১/০৮/০৩ ইং। ঘটনার তারিখ থেকে মামলা দায়েরের বিলম্বের সময় হলো ৬ বছর ২ মাস ২৫ দিন। এজাহারে এই দীর্ঘ বিলম্ভের কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। সিঙ্গাপুর সিটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ২০,৪১,২৫,৮৪৩ টাকা কোন সালে, কোন মাসে, কয় তারিখে, কোন সময় জমা হয়েছে বা অপর আসামি মামুন তার অ্যাকাউন্টে ওই অর্থ অর্জন করে মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটন করেছেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট বর্ণনা এজাহারে উল্লেখ করা হয়নি বা অভিযোগেও সুনির্দিষ্ট তারিখ, সময় ও স্থান উল্লেখ করা নেই। তবে তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা আছে ১৬/১/০৩ ইং তারিখে মোয়াজ্জম হোসেন ১১,৬৭০০০ ইউএস ডলার, মেয়ার শাইরী ০৫/৬/০৩ ইং তারিখে ৪২০৫৬৬ ইউএস ডলার, মেরিনা জামান ২৬/৯/০৩ ইং তারিখে ৩০,০০০ ইউএস ডলার, খাদিজা ইসলাম ০১/৮/০৩ ইং তারিখে ৭,৫০,০০০ ইউএস ডলার বিভিন্ন সময়ে জমাকৃত ৪,১১,৪০৪ ইউএস ডলার অর্থাৎ ২০০৩ সালের বিভিন্ন সময়ে জমাকৃত মোট ২৭,৭৮,৯৭০ ইউএস ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০,৪১,২৫,৮৪৩ টাকা আসামি মামুনের সিঙ্গাপুরস্থ সিটি ব্যাংকে ১৫৮০৫২ নম্বর অ্যাকাউন্টে জমা করা হয় এবং ওই অর্থ সম্পদ অর্জন করেন আসামি মামুন। তবে আসামি মামুন এবং তারেক রহমান আসামি মামুনের অ্যাকাউন্ট থেকে কবে, কোন তারিখে, কোন সময়, কত টাকা বা ডলার ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড ভিসা কার্ডের মাধ্যমে উত্তোলন করে গোপন করেন তারও সুনির্দিষ্ট তারিখ ও সময় এজাহারে উল্লেখ নেই, চার্জশিটে এবং অভিযোগে উল্লেখ নেই, জবানবন্দিতেও উল্লেখ নেই। মামলার এজাহারে বা চার্জশিটে ৪ বছর ৫ মাসব্যাপী ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে, যা ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ২২২ ধারার পরিপন্থী। খাদিজা ইসলাম ০১/০৮/০৩ ইং তারিখে আসামি মামুনের অ্যাকাউন্টে ৭,৫০,০০০ ডলার জমা প্রদান করায় ০১/০৮/০৩ ইং তারিখে ঘটনার তারিখ ও স্থান অভিযোগে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু আসামি মামুন বিভিন্ন উপায়ে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুর সিটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০,৪১,২৫,৮৪৩ টাকা আসামি কর্তৃক অর্জনের সুনির্দিষ্ট তারিখ বা সময় অভিযোগে উল্লেখ করা নেই। এজাহারের ভাষ্য অনুযায়ী আসামি মামুন ২০০৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত অবৈধ পন্থায় এ টাকা অর্জন করেন। এ বিষয়টি অভিযোগে সুনির্দিষ্টভাবে দিন, তারিখ, সময় উল্লেখ করা হয়নি। একইভাবে ২০০৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আসামি মামুন ৭৯,৫৪২ ডলার এবং আসামি তারেক রহমান ৫৪,৯৮২ ডলার গোল্ড ভিসা কার্ডের মাধ্যমে আসামি মামুনের অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলন করে ব্যয় করেন এবং গোপন করেন। এ অভিযোগ সম্পর্কে এজাহার, চার্জশিট এবং অভিযোগে সুনির্দিষ্ট দিন, তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। আসামিদের বিরুদ্ধে অবৈধ পন্থায় অর্থ লোপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে এ অপরাধের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিন, তারিখ ও সময় স্থান অভিযোগে উল্লেখ করা নেই। এজাহারে ও অভিযোগপত্রে বাদী ঘটনাস্থল উল্লেখ করেছেন সোনালী ব্যাংক, ক্যান্টনমেন্ট করপোরেট শাখা। বাদীর এজাহার পেয়ে থানায় মামলা দায়ের করলে প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতেও ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়েছে সোনালী ব্যাংক, ক্যান্টনমেন্ট করপোরেট শাখা। অভিযোগ গঠনকালে ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়েছে সিটি ব্যাংক ২৩ চার্চস্ট্রিট, ক্যাপিটেল স্কয়ার, সিঙ্গাপুর। অভিযোগে সোনালী ব্যাংক, ক্যান্টনমেন্ট করপোরেট শাখা ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়নি। অভিযোগে ০১/০৮/০৩ ইং তারিখে ৭,৫০,০০০ ডলার টিটির মাধ্যমে আসামি মামুনের সিটি ব্যাংক, সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্টে খাদিজা ইসলাম জমা প্রদান করেন অর্থাৎ আসামি মামুন ওই অর্থ অর্জন করেন। ফলে সিঙ্গাপুর সিটি ব্যাংককে সঠিকভাবে ঘটনাস্থল উল্লেখ করা আছে। কারণ বাদীর অভিযোগ মতে, ০১/০৮/০৩ ইং তারিখে সিঙ্গাপুর সিটি ব্যাংকে মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটিত হয়। কিন্তু ২০,৪১,২৫,৮৪৩ টাকা আসামি মামুনের সিটি ব্যাংকে গচ্ছিত থাকা সত্ত্বেও এজাহারে ঘটনাস্থল সিটি ব্যাংক সিঙ্গাপুর না দেখিয়ে সোনালী ব্যাংক, ক্যান্টনমেন্ট করপোরেট শাখা, বাংলাদেশকে দেখানো হয়েছে। একইভাবে আসামি তারেক রহমান ও মামুন সিঙ্গাপুর সিটি ব্যাংক থেকে যে অর্থ উত্তোলন করে ব্যয় করার অভিযোগ দেওয়া হয়েছে এজাহারে ও চার্জশিটে তার কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়নি। বাদীর এজাহার এবং জবানবন্দির বক্তব্যের মধ্যে খাদিজার কাছ থেকে অর্থ দাবি করার বিষয়ে বৈপরীত্য বা গরমিল পরিলক্ষিত হয়। কারণ বাদী তার জবানবন্দিতে বলেছে, তারেক রহমান খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করেন আসামি গিয়াস উদ্দিনের মাধ্যমে। বাদী এ কথা এজাহারে বলেননি। বাদী এজাহারে ভিন্ন কথা বলেছেন। বাদী তার এজাহারে বলেছেন, গিয়াস উদ্দিন আল মামুন খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করেন। এজাহারে বলেননি, তারেক রহমান খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করেন। খাদিজার কাছে অর্থ দাবির বিষয়ে এজাহারে এবং জবানবন্দিতে বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। একবার বলেছেন, আসামি গিয়াস উদ্দিন আল মামুন কার্যাদেশ পাওয়ার জন্য অর্থ দাবি করেন। আবার কখনো বলেছেন, তারেক রহমান কার্যাদেশ পাইয়ে দেওয়ার জন্য খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করেন। খাদিজার কাছে অর্থ দাবির প্রশ্নে বাদীর জবানবন্দি ও এজাহারের মধ্যে কোনো মিল পাওয়া গেল না। এ মামলার অনুসন্ধান রিপোর্টকারী সাক্ষী হলো এই পিডবি্লউ-৪ আলীমুজ্জামান। এ মামলা দায়েরের আড়াই বছর আগে পূর্বের মামলাটি দায়ের হয়। আড়াই বছর আগে একই ঘটনায় মামলা দায়েরের সময় আসামি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে খাদিজার কাছে থেকে অর্থ দাবি করার বিষয়ে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি। আড়াই বছর পর যখন একই ঘটনায় এ মামলা দায়ের হয় তখন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করে অভিযোগ দেওয়ার বিষয়টি পরবর্তী চিন্তার ফসল বলে প্রতীয়মান হয়। তাই আসামি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে খাদিজার কাছ থেকে অর্থ দাবি করার ঘটনা আদালতের দৃষ্টিতে সন্দেহজনক এবং বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসামি গিয়াস উদ্দিন আল মামুন এবং আসামি তারেক রহমান ভিসা কার্ডের মাধ্যমে কে কত টাকা উত্তোলন করে ব্যয় করেছেন বা কোন তারিখে কত টাকা উত্তোলন করেছেন এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা না পাওয়ায় এই আসামিদ্বয়ের বিরুদ্ধে ভিসা কার্ডের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ সম্পর্কে সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া গেল না। আসামি তারেক রহমান ইন্টারন্যাশনাল ভিসা কার্ডের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে তা গোপন ও আড়াল করার যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে সেই বক্তব্যেরও সত্যতা পাওয়া গেল না। কেননা আসামি তারেক রহমানের কাছ থেকে তার সম্পদ বিবরণী দুদক কর্তৃক তলব করা হলে আসামি তারেক রহমান গত ০৭/৬/০৭ ইং তারিখে সম্পদ বিবরণীতে সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে তার নামে ইস্যুকৃত একটি সাপ্লিমেন্টারি ক্রেডিট কার্ড বিদ্যমান থাকার কথা উল্লেখ করেছেন, যা আসামি মামুন কর্তৃক ইস্যুকৃত। আসামি মামুন আসামি তারেক রহমানকে একটি ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করার ঘটনা পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, আসামি তারেক রহমান বিদেশ ভ্রমণের সময় চিকিৎসা ও কেনাকাটার প্রয়োজনে আসামি মামুনের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছিলেন। সেই অর্থ আসামি তারেক রহমানের ধারও হতে পারে আবার পাওনাও হতে পারে। তারেক রহমান মামুনের অ্যাকাউন্ট থেকে ভ্রমণ এবং কেনাকাটা বাবদ ৫০,০০০ ডলারের মতো অর্থ উত্তোলন করে ব্যয় করার অর্থ এই দাঁড়ায় না যে, তিনি অবৈধভাবে মামুনের অ্যাকাউন্টে জমাকৃত অর্থ সম্পর্কে অবগত থেকে আসামি তারেক রহমান এ অর্থ গ্রহণ করেছিলেন। আসামি মামুনের অ্যাকাউন্টে অবৈধভাবে জমাকৃত অর্থ সম্পর্কে আসামি তারেক রহমান জ্ঞাত হওয়ার বিষয়টি অনুমান বা ধারণার বশবর্তী হয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু এ বক্তব্যের পক্ষে বস্তুনিষ্ঠ কোনো ধরনের কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই তারেক রহমান কর্তৃক ভিসা কার্ডের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ মানি লন্ডারিং অপরাধের সংজ্ঞাভুক্ত নয় বলে আদালতের অভিমত। টেন্ডারের কার্যাদেশ পাওয়ার সঙ্গে বা আদায়ের ব্যাপারে আসামি তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে আসামি তারেক রহমান কর্তৃক খাদিজার কাছে কার্যাদেশ আদায়ের ব্যাপারে অর্থ দাবি সম্পর্কে বা তারেক রহমান আসামি মামুনের মাধ্যমে কার্যাদেশ হাসিল করে দেওয়ার জন্য খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করা সম্পর্কে খাদিজা তার জবানবন্দিতে বা জেরাতে কোনো ধরনের কোনো বক্তব্য দেননি। অর্থাৎ বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের টেন্ডারের কার্যাদেশ আদায়ের সঙ্গে বা অর্থ দাবির সঙ্গে, অর্থ আদায়ের সঙ্গে আসামি তারেক রহমানের কোথাও কোনো সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী খাদিজা ইসলামের জবানবন্দি ও জেরাতে কোনো ধরনের কোনো তথ্য বা বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাই আসামি তারেক রহমান আসামি মামুনের মানি লন্ডারিং অপরাধের সহযোগী ছিলেন তা আদৌ প্রমাণ হয় না। রায়ে বলা হয়েছে, টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নির্মাণের কার্যাদেশ পাইয়ে দেওয়ার নিমিত্তে আসামি মামুন খাদিজার কাছে ৭,৫০,০০০ ইউএস ডলার দাবি করেন। বাদী জবানবন্দিতে তার এজাহারের উপরোক্ত বক্তব্য বলেননি। বাদী তার জবানবন্দিতে বলেন, তারেক রহমান খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করেন। ফলে দেখা যাচ্ছে এজাহার ও বাদীর জবানবন্দিতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পরিলক্ষিত হয়। এ মামলার অনুসন্ধানকারী পিডবি্লউ-৪ মীর আলিমুজ্জামান অনুসন্ধান রিপোর্ট দেন যা প্রদর্শনী-৪ চিহ্নিত আছে। সেখানে এই সাক্ষী বলেননি যে, তারেক রহমান খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করেন বা তারেক রহমান মামুনের মাধ্যমে খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করেন বা আসামি মামুন তারেকের মাধ্যমে খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করেন। অধিকন্তু একই ঘটনার আড়াই বছর আগে আসামি মামুনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় যে মামলা দায়ের করা হয়েছিল সে মামলায় অভিযোগের কোথাও বলেননি যে, আসামি তারেক রহমান খাদিজার কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কার্যাদেশ পাইয়ে দেওয়ার নিমিত্তে অর্থ দাবি করেন। সর্বোপরি খাদিজার কাছ থেকে অর্থ দাবি করার উত্তম সাক্ষী হলেন খাদিজা নিজে। পিডবি্লউ-৬ হিসেবে খাদিজা অত্র মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। খাদিজা কোথাও বলেননি, আসামি তারেক রহমান খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করেন। এমনকি এই সাক্ষী তার জবানবন্দিতে আসামি তারেকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দিয়ে সাক্ষ্য দেননি বা তারেকের নাম উল্লেখ করেননি। ঘটনার বিচার্য বিষয় প্রমাণের জন্য বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হলেন খাদিজা নিজে। আসামি তারেক খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করার বাদীপক্ষের অভিযোগটি উপরোক্ত কারণে ও অবস্থাধীনে বিশ্বাস করার মতো সঙ্গত কোনো কারণ নেই। কারণ আসামির বিরুদ্ধে বস্তুনিষ্ঠ সাক্ষ্য ছাড়া অভিযোগ প্রমাণ হয় না। আসামি তারেকের বিরুদ্ধে বস্তুনিষ্ঠ একমাত্র সাক্ষী খাদিজা। খাদিজা নিজেই আসামি তারেকের বিরুদ্ধে অর্থ দাবি সম্পর্কে কোনো ধরনের কোনো অভিযোগ না দেওয়ায় আসামি তারেক কর্তৃক অর্থ দাবির অভিযোগটি বাদীপক্ষ প্রমাণ করতে সমর্থ হয়নি। আসামি তারেকের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হলো ইন্টারন্যাশনাল সাপ্লিমেন্টারি গোল্ড ভিসা কার্ডের মাধ্যমে চুয়ান্ন হাজার ডলারের বেশি অর্থ আসামি মামুনের অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলন করে ভ্রমণ, কেনাকেটা ও চিকিৎসার জন্য ব্যয় করেছেন এবং এ অর্থের বিষয়টি গোপন ও আড়াল করে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ করেছেন। বাদী পিডবি্লউ-১ হিসেবে তার জবানবন্দিতে বলেছেন, আসামি তারেক ভিসা কার্ডের মাধ্যমে চুয়ান্ন হাজার ডলারের বেশি অর্থ মামুনের অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলন করে বিভিন্নভাবে ব্যয় করে গোপন ও আড়াল করেন। পিডবি্লউ-২ ডেবরা লা প্রিভট্টি তার জবানবন্দিতে বলেছেন, আসামি তারেক রহমান ও মামুন ভিসা কার্ডের মাধ্যমে ৫০৬১৩.৯৭ ইউএস ডলার উত্তোলন করে ব্যয় করেন। এই সাক্ষী সিঙ্গাপুরস্থ সিটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে আসামি মামুনের ১৫৮০৫২ নং অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করেন। পিডবি্লউ-১ দুদকের পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুরস্থ সিটি ব্যাংক থেকে মামুনের অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করে। পিডবি্লউ-২ বলেছে দুদকের স্টেটমেন্ট এবং এফবিআই’র পক্ষ থেকে সংগৃহীত স্টেটমেন্ট মিল রয়েছে। কিন্তু তার এ বক্তব্য তার দাখিলি দালিলিক সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত হয় না। কেননা বাদী বলেছেন, চুয়ান্ন হাজারের বেশি মার্কিন ডলার উত্তোলন করে খরচ করেন। অন্যদিকে পিডবি্লউ-২ বলেছে ৫০ হাজারের বেশি মার্কিন ডলার উত্তোলন করে খরচ করেন। উভয় সাক্ষীর বক্তব্যে ও দাখিলি স্টেটমেন্টে আসামি তারেক রহমান কর্তৃক ভিসা কার্ডের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থের পরিমাণে গরমিল পরিলক্ষিত হয়। পিডবি্লউ-১ বলেছে ২০০৩-০৭ সাল পর্যন্ত এই অর্থ আসামি তারেক রহমান উত্তোলন করেন। বাদীর অভিযোগ হলো, আসামি তারেক রহমান সিংহভাগ অর্থ উত্তোলন করে গোপন করেছেন। ২০০৩-০৭ সাল অর্থাৎ দীর্ঘ চার বছরে আসামি মামুনের জমাকৃত ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকার মধ্যে বেশির ভাগ টাকা সিঙ্গাপুরস্থ সিটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থেকে আসামি তারেক উত্তোলন করেছেন। আসামি তারেক রহমান যদি মূল টাকার শরিক হতেন বা মালিক হতেন তাহলে মামুনের অ্যাকাউন্টে জমাকৃত ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকার মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার মার্কিন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৩৫ লাখ টাকা গ্রহণ করতেন না। আসামি তারেক রহমান যদি মামুনের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ অর্জন করে সিঙ্গাপুরে মামুনের অ্যাকাউন্টে জমা করতেন তাহলে জমাকৃত ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকার সিংহভাগ আসামি তারেক কর্তৃক নিজ স্বার্থে উত্তোলন বা খরচ করতেন। কিন্তু আসামি তারেক রহমান মাত্র ৩৫ লাখ টাকা উত্তোলন করে খরচ করেছেন। ফলে যুক্তিসঙ্গত কারণে বিশ্বাস করা যায় না যে, আসামি তারেক রহমান আসামি মামুনের অ্যাকাউন্ট থেকে ভিসা কার্ডের মাধ্যমে মাত্র ৩৫ লাখ টাকা উত্তোলন করে মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটন করেছেন এবং তারেক রহমান মূল টাকার মালিক বা ভাগিদার ছিলেন। অধিকন্তু আসামি তারেক রহমান ভিসা কার্ডের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরস্থ মামুনের সিটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করে গোপন করেছেন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২(ঠ) (আ) সংজ্ঞাতে বলা আছে, বৈধ বা অবৈধ পন্থায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্থ সম্পদ আহরণ করে রূপান্তর, হস্তান্তর, গোপন বা আড়াল করলে তা মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। রাষ্ট্রপক্ষের মূল অভিযোগ হলো, আসামি তারেক গোল্ড ভিসা কার্ডের মাধ্যমে বিদেশি সিটি ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করে তা গোপন বা আড়াল করেছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্ত রিপোর্ট জুডিশিয়াল রেকর্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিচার্য বিষয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ এই অংশ পাশ কাটিয়ে এ মামলায় কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তদ্বারা ন্যায়বিচার বিঘি্নত হবে। উপরোক্ত সাক্ষী সাবুদ ও আইনগত অবস্থা বিশদভাবে পর্যালোচনান্তে আসামি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২০০২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ১৩ ধারার মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ এবং মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধের সহায়তার অভিযোগ প্রসিকিউশন পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রমাণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। তাই মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধের দায় থেকে আসামি তারেক রহমানকে নির্দোষ সাব্যস্তে খালাস প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো।