দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই লক্ষ্যে যা যা করার সবই করছে সরকার। ইতোমধ্যেই নির্বাচনের তফসিলও ঘোষণা করা হয়েছে। অন্য দিকে সরকারের এ অবস্থানের তীব্র বিরোধিতা করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলীয় জোট বলছে, এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না তারা। একই সাথে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক জোট এখন মুখোমুখি অবস্থানে। নির্বাচন প্রতিহত করতে বিরোধী জোট ইতোমধ্যেই হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। এসব কর্মসূচিতে বহু হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। এ পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনই এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। নির্বাচন ঘিরে সামনে আর কী ঘটতে পারে তা নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে সবখানে। রাজনৈতিক বিশ্লেøষকেরা মনে করছেন, রাজধানী ঢাকা বাদ দিয়ে দেশের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা ইতোমধ্যেই বিরোধী জোটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এক সময় রাজধানীতেও নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে সরকার। রাজধানীর বাইরে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কোনো কোনো স্থানে আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে তারা। সরকারের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ায় এ মুহূর্তে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চান না তারা। এ অবস্থায় সরকারি দলের নেতাকর্মীরাও রয়েছেন বেকায়দায়। ঢাকার বাইরে কোনোভাবেই মাঠে নামতে পারছেন না তারা। চরম গ্রুপিং ও দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত তৃণমূল নেতাকর্মীরা নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছেন। দু-একটি জায়গায় প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। আর সরকারি দলের এমপিরাও রয়েছেন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। বেশির ভাগ এমপি আতঙ্কে নিজ নিজ এলাকায় যেতে পারছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, আসলে রাজধানীতে বসে অনেক কিছুই বলা যায়। মনে হচ্ছে সব কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। মাঠপর্যায়ে গেলে দেখা যায় সাধারণ মানুষ কতটা ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তারা শুধু সুযোগের অপেক্ষায়। দলের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য জানান, মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। তারা কোথাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। রাস্তায় দাঁড়াতে গেলে মার খাচ্ছেন। এভাবে তাদের মনোবল ভেঙে পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে নির্বাচনে দলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সরকারের বিভিন্ন সূত্র জানায়, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে দল ও সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মুখে মাঝে মধ্যে কিছুটা ইতিবাচক কথাবার্তা শোনা গেলেও আসলে তা সরকারের সিদ্ধান্ত নয়। এর মাধ্যমে বিরোধী দলকে সংলাপমুখী রেখে বড় ধরনের আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে চান সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। পাশাপাশি দলের নির্বাচনী প্রস্তুতিও শেষ করতে চান তারা। ইতোমধ্যেই প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করে ফেলেছে দলটি। আর শেষ সময়ে সংবিধান থেকে কোনো রকম ছাড় না দিয়েই নির্বাচনের দিকে যাবে সরকার। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, বিএনপি মুখে যাই বলছে, তারা আসলে নির্বাচনমুখী। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের শতভাগ ধারণা আগামীতে কোনোভাবে নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। তাই শেষ মুহূর্তে কোনো ধরনের আন্দোলনে না গিয়ে নেতাকর্মীদের চাপে হলেও তারা নির্বাচনে যেতে বাধ্য হবে। সে জন্য নির্বাচন ইস্যুতে বিরোধী দলের সাথে কোনো রকম সমঝোতার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন না সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। আর বিএনপি যদি কোনো কারণে নির্বাচনে না আসে তবে বিরোধী জোটের শরিকদের নানা চাপ বা প্রলোভন দেখিয়ে নির্বাচনে নিয়ে আসার কথাও সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় রয়েছে নীতিনির্ধারকদের। পাশাপাশি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ভেঙে এক অংশকে নির্বাচনে বাধ্য করার কথাও ভাবছে সরকারের একটি প্রভাবশালী অংশ। এতে বর্থ হলে সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত বিএনপি থেকে ছিটকে পড়া নেতাদের নির্বাচনে নিয়ে আসা হতে পারে। সেই লক্ষ্যে এখন থেকেই বিএনপির সিনিয়র নেতাদের নানা মহল থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া সফল হলে মূল বিএনপি নির্বাচনে না এলেও নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য করা যাবে বলে মনে করছেন তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনে সরকার বদ্ধপরিকর। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অধীনে এ নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপি না এলে একক নির্বাচনের পথেই হাঁটবে তারা। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের বিশৃঙ্খলা রোধে নেতাকর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ ও নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে মাঠ দখলে রাখার গুচ্ছ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই বিএনপির সিনিয়র কয়েক নেতাকে কারাবন্দী করা হয়েছে। বন্দী করা হতে পারে আরো একাধিক শীর্ষ নেতাকে। তাদেরকে জেলে রেখেই নির্বাচনের কাজ সারতে চায় সরকার। উন্মুক্ত সভা সমাবেশে চলছে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। মাঠে দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না বিরোধী জোটের প্রধান শরিক জামায়াতকে। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এ অবস্থা বহাল রাখার পরিকল্পনা সরকারের। পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠ দখলে রাখতে চায় তারা। বিশেষ করে রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোতে দলীয় অবস্থান মজবুত করতে চায় আওয়ামী লীগ। এর অংশ হিসেবে রাজপথে মিছিল, সমাবেশ, মহাসমাবেশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয় থাকবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। বিরোধী দল রাজপথে দাঁড়াতে চাইলে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। অন্য দিকে বিরোধী জোট মনে করছে, বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোতে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। তাই সরকার গায়ের জোরে কিছু করতে গেলে হরতাল, অবরোধ ও অবস্থানের মাধ্যমে দেশ অচল করে দেয়া হবে। গত কয়েক দিনে তার মহড়া দেয়া হয়েছে মাত্র। সামনে আরো কঠোর কর্মসূচি অপেক্ষা করছে। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নামতে বাধ্য করা হবে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হবে না। সরকার আসলে সংলাপ বা আলোচনায় আন্তরিক নয়। তাই সমাধান হবে রাজপথেই। তাদের ধারণা, ধীরে ধীরে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর সরকার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যেই অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। বিরোধী দলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে রাজধানী ঢাকাও। কর্মসূচি প্রণয়নে এই বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কারণ ওই সময় নেতাকর্মীরা শতভাগ ‘ঝুঁকি’ নিতে চাইবে। রাজনৈতিক এ চরম অনিশ্চয়তায় আসলে কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে সব মহল উদ্বিগ্ন।