দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নাশকতার আশঙ্কায় ভোটগ্রহণের বেশ কিছু দিন আগে সেনাবাহিনী মোতায়েন চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় যে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে নির্বাচনের মাঠে আগাম নেমে ‘বিতর্কিত’ হতে চায় না সেনাবাহিনী।
আর এ কারণেই বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে বৈঠকে দ্বিমত পোষণ করেছেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও)। সিইসি নির্বাচনের ‘অন্তত ১৫ দিন আগে’ সেনা নামানোর কথা বললেও ভোটগ্রহণের মাত্র কয়েক দিন আগে মাঠে নামার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি।
বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেছেন, ‘এ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট অন্যান্য নির্বাচন থেকে ভিন্ন। এ নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। সেজন্য আগে থেকেই সেনাবাহিনী মোতায়েন করা উচিৎ।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভোটাররা আতঙ্কিত হলে নির্বাচনের প্রতি আস্থা কমে যাবে। তাদের আস্থা অর্জন করা জরুরি। তাই সেনা আগে থেকেই নামানো দরকার।’
তার এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনীর পিএসও লেফটেন্যান্ট জেনারেল বেলাল মোহাম্মদ সাইফুল হক আপত্তি তোলেন। তার মতে, এতো তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনী মাঠে নামালে এ বাহিনী বিতর্কিত হতে পারে। তাই অন্যান্য নির্বাচনের মতো এবারও তারা নির্বাচনের কয়েকদিন আগেই বাহিনী মোতায়েন করতে চান।
‘কবে থেকে সেনাবাহিনী প্রয়োজন’ সিইসির কাছে পিএসও জানতে চাইলে উত্তরে সিইসি বলেন, ‘অন্তত ১৫ দিন আগে’। তবে দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত করেননি রিটার্নিং অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা করে তা ঠিক করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
বৈঠক জানায়, ইসির একজন কমিশনার মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন থেকে সেনা মোতায়েনের কথা বলেন।
কিন্তু তাদের যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন পিএসও।
তবে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর শীতকালীন মহড়া রয়েছে। এ মহড়া শেষে ইসির সহায়তায় সেনারা কাজ করবে বলে জানা গেছে। আর বিশেষ কারণে তার আগে সেনাবাহিনী প্রয়োজন হলে সে বিষয়টি ভেবে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন পিএসও।
কমিশন সূত্রে জানা যায়, সাধারণত আগের নির্বাচনগুলোতে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পরেই রিটার্নিং অফিসারদের নিয়ে সভা করা হতো। সে সভায় সেনাবাহিনী নামানোর বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়। সে অনুযায়ী, এ সভাটি এবারও ১৬ ডিসেম্বর মনোয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পরেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
উল্লেখ্য, বিগত প্রায় সবক’টি নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সর্বোচ্চ সাতদিন আগে সেনাবাহিনী মাঠে নেমেছিল। ২০০৮ এর নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগে পরে মিলিয়ে ১২ দিন সেনা মোতায়েন ছিল। আর ১৯৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির একতরফা নির্বাচনে সেনাবাহিনী মাঠে ছিল ২০ দিন।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র্যাব) মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান। কেবল রাস্তায় নয় পাড়া মহল্লায়ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের যেতে হবে বলে মত দেন তিনি।
অন্যদিকে একজন গোয়েন্দাপ্রধান ‘গুপ্ত হামলা’ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে সিইসি জেলাভিত্তিক নির্বাচন কার্যালয়গুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করার কথা বলেন।
সভায় নির্বাচনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ ১০ হাজার বিজিবি সদস্য দেয়ার কথা জানিয়েছেন। গত নির্বাচনে সাড়ে ৭ হাজার বিজিবি সদস্য কাজ করেছে জানিয়ে এবার তিনি এ সংখ্যার কথা জানান।
তবে অধিক পরিমাণে আনসার সদস্যদের মাঠে থাকার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এনএসআইয়ের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মনজুর আহমেদ। তার এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আনসারও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল নাজিম উদ্দিন নির্বাচনের সময় সর্বোচ্চ সাত দিন আনসার সদস্যদের মাঠে রাখা সম্ভব বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের ৩৫ হাজার অস্ত্র আছে। সে অনুযায়ী সাত দিনের বেশি আমাদের পক্ষে মাঠে থাকা সম্ভব না।’
বৈঠক সূত্র নিশ্চিত করেছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে ক্যাম্প গঠন করার প্রস্তাব এসেছে। তফসিল ঘোষণার পর যে ধরনের ‘নাশকতার’ আশঙ্কা করা হয়েছিল তা হয়নি বলেও মন্তব্য করেন কেউ কেউ। কয়েকদিনের মধ্যেই পুরো পরিস্থিতি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলেও সিইসিকে আশ্বাস দেয়া হয়।
তবে গোয়েন্দা প্রধানরা তাদের তথ্যের ভিত্তিতেই পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সিইসির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বলে বৈঠকের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে কোনো মন্তব্য করেননি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী প্রধানদের কেউ-ই। শুধু সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেনাবাহিনী প্রস্তুত। প্রয়োজন হলেই তারা মাঠে নামবে। তবে রিটার্নিং অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা করেই দিনক্ষণ ঠিক করা হবে।’