তৌফিক-ই-ইলাহীর বিরুদ্ধে ৩৫ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ

0
127
Print Friendly, PDF & Email

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। সেই বৈরী সময় তৎকালীন সরকারকে ১৭ এপ্রিল গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে মুজিবনগর সরকারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। এ কারণে তাকে স্বাধীনতার সম্মানসূচক বীর বিক্রম খেতাবও দেওয়া হয়। পরে তিনি যোগ দেন সরকারের প্রশাসন বিভাগে। এরপর চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখেন ড. চৌধুরী। ২০০৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি জ্বালানি সচিবেরও দায়িত্ব পালন করেন। তবে অভিযোগ রয়েছে, এখান থেকেই তার দুর্নীতির যাত্রা শুরু।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা করা হয় তৌফিক-ই-ইলাহীকে। তিনি হয়ে ওঠেন এই মন্ত্রণালয়ের একচ্ছত্র অধিপতি। তার বিরুদ্ধে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ দেখা, দুর্নীতিসহ বেশ কিছু অভিযোগ ওঠে গত পাঁচ বছরে। গণমাধ্যমে তিনি সমালোচিতও হন। এসব কারণে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের উপদেষ্টা থেকে তার নাম বাদ পড়ে।

শেভরন কেলেঙ্কারিতে ড. তৌফিক জড়িত : অভিযোগ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা থাকাকালে তৌফিক-ই-ইলাহী মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনকে ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (৩৭০ কোটি টাকা) একটি গ্যাস কমপ্রেসারের কাজ পাইয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়েছেন। তৌফিক-ই-ইলাহীর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত এ অভিযোগটি করেন পেট্রোবাংলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে জনৈক আবু সিদ্দিকী। অভিযোগটি প্রধানমন্ত্রী তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তের জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয় পেট্রোবাংলার কাছে তদন্তের দায়িত্ব দিলেও তৌফিক-ই-ইলাহীর বিরুদ্ধে পেট্রোবাংলা কোনো তদন্ত না করে মন্ত্রণালয়ের কাছেই তদন্তের ভার ফিরিয়ে দেয়। পরে জ্বালানি মন্ত্রণালয় তদন্তের দায়িত্ব নেয়। তবে তৎকালীন জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ মোহসিনের (২০১০ সালে দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্বালানি সচিব) বিরুদ্ধেও অভিযোগ থাকায় এ তদন্তের কোনো ফলাফল আজো প্রকাশ হয়নি। এ বিষয়টি দৈনিক আমার দেশে প্রকাশিত হলে তৌফিক-ই-ইলাহীর পক্ষ থেকে ওই দৈনিকটির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হয়। মামলায় পত্রিকাটির সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান দীর্ঘ দিন কারাভোগ করেন।

অভিযোগে বলা হয়, জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুল হক, সচিব মোহাম্মদ মোহসিন ও পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মোক্তাদির আলী পারস্পরিক যোগসাজশে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি শেভরনকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রায় ৩৭০ কোটি টাকার সমান ৫২ দশমিক ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে কমপ্রেসার স্টেশন বসানোর কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়, কাজটি শেভরনকে পাইয়ে দেওয়ার জন্য তৌফিক-ই-ইলাহী ৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর তদন্তের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও গত চার বছরেও এ তদন্তকাজ শেষ হয়নি।

শেভরনকে কমপ্রেসার কেনার কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ প্রসঙ্গে গতকাল তৌফিক-ই-ইলাহীর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হয়। তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে জ্বালানি উপদেষ্টা থাকাকালে তিনি এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এ রকম একটি তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর আমি দৈনিক আমার দেশের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছি। বেনামি একটা চিঠির ভিত্তিতে খবরের কাগজে এ রকম চরিত্রহননের কারণে আমি মানহানির মামলা করেছি। বিষয়টি বিচারাধীন রয়েছে।’ এ বিষয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা উড়ো চিঠির ওপর, একটা বেনামি চিঠির ওপর; যার অস্তিত্ব নেই তার ওপর ভিত্তি করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। মামলা বিচারাধীন রয়েছে।’ এদিকে উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া গোপন তারবার্তা থেকেও শেভরনের গ্যাস কমপ্রেসার কেনার সঙ্গে তৌফিক-ই-ইলাহীর সংশ্লিষ্টতার বিষয় জানা যায়। ২১ ডিসেম্বর, ২০১০ সালে ফাঁস হওয়া উইকিলিকসের এক গোপন তারবার্তায় (যার রেফারেন্স আইডি : 09DHAKA741) বলা হয়, চলমান জ্বালানি সংকট থেকে উত্তরণের একটা উপায় হতে পারে বাংলাদেশের প্রধান সরবরাহ লাইনে কমপ্রেসার যুক্ত করা, কমপ্রেসার যুক্ত করলে শেভরনের বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জবাবে জানান, ‘বাংলাদেশ শেভরনকে তিনটি কমপ্রেসারের মধ্যে একটি বসানোর অনুমোদন প্রদানের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।’ উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া গোপন তারবার্তার সূত্র ধরে দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেভরনের কাছ থেকে একটি কমপ্রেসার কেনার ব্যাপারে আগেই মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে কথা দিয়েছিলেন তৌফিক-ই-ইলাহী। এ ব্যাপারে শেভরন তৌফিক-ই-ইলাহীকে মোটা অঙ্কের ঘুষ প্রদান করবে, এটাই স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুরো বিষয়টিই হয়েছে অনিয়মের মধ্য দিয়ে। যদি নতুন একটি কমপ্রেসার মেশিন কেনা হয়, তাহলে বর্তমান তার বাজারমূল্য ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেখানে পুরনো কমপ্রেসার মেশিন শেভরনের কাছ থেকে কিনেছেন প্রায় ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এই ৫৩ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন তো সরাসরি বাড়তি। যেহেতু পুরনো মেশিন সেহেতু এর দাম ৩৫ মিলিয়ন ডলারও নয়। পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তার বরাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ দুর্নীতি তদন্ত করার জন্য বিস্তারিত একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি ওই চিঠির সূত্র ব্যবহার নাও করি, তাহলে পারিপার্শি্বক বিবেচনায় এটা বলা যায় যে এখানে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। কারণ, যেখানে নতুন মেশিনের দাম ৩৫ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ৫৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করে পুরনো মেশিন কেনার কারণই হলো বড় ধরনের ঘুষের লেনদেন।

শেয়ার করুন