রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই- এ কথাটি বারংবার প্রমাণ করে যাচ্ছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ। ঘণ্টায় ঘণ্টায় তার মত আর অবস্থান পাল্টানোর ঘটনা ঘটছে সাম্প্রতিক সময়ে। নির্বাচনে অংশ নেবেন না- এমন বক্তব্য দেয়ার পরের দিনই সুর পাল্টালেন। যোগ দিলেন সর্বদলীয় সরকারে। যদিও তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, তিনি আর মহাজোটে নেই। আগামি নির্বাচনে একাই লড়বেন। কিন্তু তার এ অবস্থান ভালোভাবে নেয়নি তৃণমূল জাপা। সারাদেশের মানুষও তাকে ধিক্কার দিচ্ছেন। সঙ্গে দলের শীর্ষ নেতাদের বিষেদগার শুনতে হচ্ছে। দলের দীর্ঘ দিনের সহযোগী কর্মীরাই তাকে সম্বোধন করছেন ‘বিশ্ব বেঈমান’ হিসেবে।
শুধু এসব বলেই ক্ষান্ত নন তারা। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা মো. মুজিবুর রহমান যুক্তিবাদী পদত্যাগ করেছেন। দীর্ঘদিনের সহযোগী কাজ জাফরও তার কড়া সমালোচনা করেছেন। গুঞ্জন রয়েছে বর্তমানে চিকিৎসাধীন থাকা এই নেতা সুস্থ হলেই জাপা থেকে সরে দাড়ানোর ঘোষণা দিতে পারেন। অবশ্য কাজী জাফর বলেছেন, তিনি দল ছাড়বেন না। তবে সর্বদলীয় সরকার থেকে বের না হলে তৃণমূল নেতারাই সিদ্ধান্ত নেবেন কি হবে।
রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির নেতারাই সিদ্ধান্ত নেবেন জাতীয় পার্টিতে কারা থাকবে আর কারা থাকবেন না। আমি জাতীয় পার্টিতে এখনো আছি। একই সঙ্গে এরশাদ জাতীয় পার্টিতে থাকবেন কি না এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মনে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, এরশাদের মতো এতো ডিগবাজি দেয়া লোক পৃথিবীতে নেই। আমি একশত বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে এরশাদের মতো বিশ্বাসঘাতক নেতা দেখিনি। আমরা এরশাদকে নেতা মানি না। এরশাদের জাতীয় পার্টিতে আমরা নেই। তার আস্তানায় ফিরে যাবো না। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অনঢ়, জাতির কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ।
এদিকে খোজ নিয়ে জানা গেছে, দলীয় নেতাকর্মীদের তোপের মুখে অনেকটাই চাপে আছেন এরশাদ। সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিয়ে তার দলের জনপ্রিয়তা যে অনেকাংশেই কমে গেছে সেটাও তিনি বুঝতে পেরেছেন। সে কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছেন না বিতর্কিত এই নেতা। এজন্য নির্বাচন বর্জনের ইস্যুও খুজে বেড়াচ্ছেন। বড় ধরনের কোন ইস্যু পেলেই নির্বাচন থেকে সড়ে দাড়ানোর ঘোষণা দিতে পারেন। সম্প্রতি হাসপাতালে কাজী জাফরকে দেখতে গিয়ে নানান প্রশ্নের মুখে পড়েন এরশাদ। এসময় কাজী জাফর তার কড়া সমালোচনা করেন। সেসময় এরশাদ কাজী জাফরকে আশ্বস্ত করেন, নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দিবেন তিনি। তবে সেক্ষেত্রে বড় ধরনের কোন ইস্যুকে কাজে লাগাতে হবে। তখন কাজী জাফর তাকে বলেছেন, কোন ইস্যুর দরকার নেই। আপনি সর্বদলীয় সরকার থেকে বেরিয়ে আসুন। দেখবেন জনগণ আপনাকে সমর্থন দেবে। তাতে জাপাই লাভবান হবে।
দলের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, জাপার প্রেসিডিয়াম সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকবে না ও সবার অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু মন্ত্রীত্ব পাওয়ার লোভে দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু এরশাদকে সর্বদলীয় সরকারের যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। পরে মহাজোট সরকারের সময়ে মন্ত্রী পাওয়া জিএম কাদের বারংবার অনুরোধ করেছেন দলের চেয়ারম্যানকে। এরপর ১৪ দলের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা তাকে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এবং বিএনপিও নির্বাচনে আসবে। আর না আসলে জাপাই বিরোধীদল হয়ে যাবে। এর সঙ্গে মঞ্জুর হত্যা মামলাসহ কয়েকটি মামলা তাকে জেল খাটানো হতে পারে এমন আশঙ্কাও ছিল তার মধ্যে। চারদিক থেকে এমন পরামর্শ আর লোভ দেখানোয় মত ঘুরে যায় এরশাদের। প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াই তিনি সর্বদলীয় সরকারে যোগ এবং আওয়ামী সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তাকে বেশি ইন্ধন দিয়েছেন গত নির্বাচনী হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেয়া সংসদ সদস্য ও দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার।
দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কাজী জাফর দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। সুস্থ হলেই তিনি দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ, যুবসমাজ ও ছাত্র সমাজের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। পরে তিনি প্রতিটি জেলা ও উপজেলা জাপার সভাপতির সঙ্গে বৈঠক করবেন। এজন্য তাদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ শুরু করেছেন। তাদের সঙ্গে বৈঠক করার পরেই জাপার কাউন্সিল ডাকতে পারেন। এমনকি সর্বদলীয় সরকার থেকে বের হয়ে আসতে দুই-তিন দিনের সময় দিতে পারেন কাজী জাফর। ওই সময়ের মধ্যে এরশাদ সর্বদলীয় সরকার থেকে বের না হলে এবং সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন অংশ না নেয়ার ঘোষণা না দিলে কাউন্সিল ডেকে তৃণমূল নেতারা এরশাদকেও দল থেকে বের করার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কাজী জাফরের ঘণিষ্ঠসূত্রও এটি নিশ্চিত করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দলের মাঠ পর্যায়ের হাজার হাজার নেতাকর্মী পাতানো নির্বাচনে অংশ নিতে নারাজ। নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে জাতীয় পার্টির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে এখনো বিভ্রান্তি রয়েছে। বিরোধীদলের জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচির মধ্যে যারা প্রার্থী হবেন তারা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। প্রচারণায় অংশ নিলে গণরোষে পড়তে হবে এটা এরশাদকে জানানো হয়েছে।
জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা জানান, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দলের নেতাকর্মীরা অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে জনগণের বিপক্ষ্যে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে নারাজ। কারণ তারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছেন ৫ বছর আওয়ামী লীগ যুবলীগ, ছাত্রলীগ শুধু জনগণের জন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেছেন। মহাজোটের শরিক হওয়ার পরও জাতীয় পার্টির নেতাদের কোনো সুযোগ দূরের কথা সম্মান দেখানো হয়নি। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা পিঠ এগিয়ে দিতে পারে না।