উত্তর পূর্ব ভারতের আগরতলা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক সংবাদ’ বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ‘সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনাই বাঞ্ছনীয়’শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লিখে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়, গণতন্ত্রের শৈশব হইতে যৌবনে উত্তরণের প্রয়াসী বাংলাদেশে এখন বড়রকম প্রশ্নের মুখে এসে পড়েছে নির্বাচন। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সন্দেহ।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়, বিএনপি দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করলেও গত ৩টি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ততটা মধুর নয়। দেখা গিয়েছে, তিনমাসের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতায় এসে তারা কাটিয়ে দিয়েছে পুরো দু’বছর।
জন্মের পর হইতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশের পথে বারবারই সেনাবাহিনী প্রতিবন্ধক হয়েছে মন্তব্য করে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, একসময় গণতন্ত্রের জন্য হুমকি সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্রের প্রহরী হতে চলেছে।
আজ বুধবার দৈনিক সংবাদে ‘সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনাই বাঞ্ছনীয়’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়টি হুবহু তুলে ধরা হল:
যেকোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন হইতেছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশের মানুষ কেমন বা কোন দলের সরকার চান তাহা জানাইয়া দেন। এক কথায় গনগণের হাতে ক্ষমতার একমাত্র উৎসই হইতেছে নির্বাচন। গণতন্ত্রের শৈশব হইতে যৌবনে উত্তরণের প্রয়াসী বাংলাদেশে সেই নির্বাচনই এখন বড়রকম প্রশ্নের মুখে আসিয়া পড়িয়াছে। শেষ পর্যন্ত দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান আদৌ সম্ভব হইবে কিনা তাহা হইয়াই প্রশ্ন দেখা দিয়াছে। দেশের নির্বাচন কমিশন অবশ্য আগামী ৫ই জানুয়ারী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন ধার্য করিয়াছেন। নির্বাচনের নির্ঘন্টও ঘোষণা করিয়া দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিবে না বলিয়া জানাইয়া দিয়াছে। শুধু তাহাই নহে। নির্বাচনকে বানচাল করিয়া দিতে তাহারা জলে-স্থলে প্রতিরোধের ডাক দিয়াছে। এই প্রতিরোধের চেহারা কি হইতে পারে প্রথম দিনেই দেশের মানুষ কিছুটা তাহার নমুনা দেখিতে পাইয়াছেন। দেশজুড়িয়া ব্যাপক হিংসাত্তম কর্মকান্ড শুরু হইয়া গিয়াছে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন এই হিংসার বলি হইয়াছেন। আহত হইয়াছেন আরও অনেকে। আগামী দিনগুলিতে এই হিংসার চেহারা আরও ভয়াবহ হইতে পারে বলিয়াও বিএনপি নেতারা জানাইয়া দিয়াছেন।
জন্মের পর হইতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশের পথে বারবারই সেনাবাহিনী প্রতিবন্ধক হইয়াছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করিয়া তাহারা ক্ষমতা দখল করিয়াছে। এইবারে কিন্তু সেনাবাহিনীর দিক হইতে তেমন কোন হুমকি আসে নাই। দেশের গণতান্ত্রিকভাবে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলই গণতন্ত্রকে বানচালের হুমকি দিতেছে। পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় দাঁড়াইয়াছে যে শেষ পর্যন্ত এই সেনাবাহিনীকেই হয়তো গণতন্ত্র রক্ষায় পথে নামিতে হইবে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ হইতে ইতিমধ্যেই জানানো হইয়াছে যে হিংসাত্তক ঘটনা প্রতিহত করিতে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে ডাকার কথা তাহারা ভাবিতেছেন। অর্থাৎ একসময় যে সেনাবাহিনী ছিল প্রধান হুমকি সেই এখন গণতন্ত্রের প্রহরী হইতে চলিয়াছে।
পরিস্থিতি যেইদিকে যাইতেছে তাহাতে নির্বাচন কমিশনের সামনে হয়তো অন্য কোন পথই খোলা থাকিবে না। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ জানাইয়াছেন যত প্রতিরোধই আসুক না কেন, যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাহারা বদ্ধ পরিকর। এই কথা বলিলেও তিনি কিন্তু সব পথ রুদ্ধ করিয়া দেন নাই। তিনি বলিয়াছেন এখনও যদি রাজনেতিক দল সমূহ নির্বাচনকালীন সরকার লইয়া কোন সমঝোতায় উপনীত হইতে পারেন তবে কমিশন নির্বাচনের দিনক্ষণ পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিতে পারে। সাধারণত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হইয়া গেলে তাহা আর পরিবর্তন হয় না। তাহা সত্ত্বেও কাজী আহমেদ যে বিবেচনার আশ্বাস দিয়াছেন তাহাকে নির্বাচন বিরোধীরা একটা সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করিতে পারেন। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই তাহাদের বিষয়টি বিবেচনার প্রয়োজন রহিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে।
বিএনপি দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে দাবী জানাইতেছে। ইহা ঠিক যে এই ব্যবস্থায় বাংলাদেশে তিনটি নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হইয়াছে। কিন্তু দল নিরপেক্ষ সরকারের সর্বশেষ অভিজ্ঞতা কিন্তু ততটা মধুর নহে। আগে দেখা গিয়াছে তিন মাসের জন্য ক্ষমতায় আসিয়া তাহারা প্রায় দুই বছর কাটাইয়া দিয়াছেন। কেবলমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব লইয়া আসিলেও এই সময়ে তাহাদের কাজকর্মও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে ছিল না। তুলনায় বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের অভিজ্ঞতা কিন্তু অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য বলিয়া মনে করা যাইতে পারে। এইসব দেশের অভিজ্ঞতা বলিতেছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে হইলেও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হাত বদলের ক্ষেত্রে তারা কোনমতেই প্রতিবন্ধক হয় নাই। বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহায়কই হইয়াছে। এই অভিজ্ঞতা হইতে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা অবশ্যই শিক্ষা লইতে পারেন।
এই ব্যবস্থায় দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকিলেও দৈনন্দিন কাজকর্ম চালানো ছাড়া তাহাদের কার্যত: কোন ক্ষমতাই থাকে না। নির্বাচন নির্ঘন্ট ঘোষণার পর কার্যকর সব ক্ষমতাই চলিয়া যায় নির্বাচন কমিশনের হাতে। মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী যেই হোন না কেন, তাহারা নির্বাচনী আচরণবিধি মানিয়া চলিতে বাধ্য থাকেন। বাংলাদেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারও আচরণবিধি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখিবার আশ্বাস দিয়াছেন। দেশের রাজনৈতিক দল সমূহ এই আশ্বাসের উপর আস্থা রাখিলে তাহা বোধ হয় জাতির জন্য মঙ্গলই হইবে। দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করিয়া বিএনপি নেতারা তাহাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিতে পারেন।”