শেষ ভরসা এবং আশার প্রদীপটিও নিভে গেল। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে দেশ দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে নিক্ষিপ্ত হল। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ৩টার সময় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অবরোধের প্রথম ৭ ঘণ্টায় তিনটি তাজা প্রাণ ঝরে গেল। বৃস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত আর ক’টি প্রাণ যে ঝরে যাবে, সেটি আমরা কেউ জানি না। এই তিনটি প্রাণহানির মধ্য দিয়ে যদি এই ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের অবসান ঘটত তাহলেও না হয় একটি কথা ছিল। কিন্তু এটি আসলে দ্বিতীয় পর্যায়ের সহিংসতার শুরু। প্রথম পর্যায়ের রক্তক্ষয় শুরু হয়েছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে। তার পর ২৫ শে নভেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটেছে ২৬৮ জনের। ২৫ শে নভেম্বর রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত রক্তপাত এবং প্রাণহানির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হলো। কেউ যদি মনে করেন যে, সরকার ঘোষিত ২০১৪ সালের ৫ ই জানুয়ারী অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে এই ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট তথা রক্তপাতের অবসান ঘটবে, তাহলে তিনি মারাত্মক ভুল করছেন। কারণ, এই সংকটের অবসান বিরোধী দলের ওপর নির্ভর করছে না, নির্ভর করছে সরকারী দলের ওপর। সরকারী দল আগামী দিনগুলিতে বিশেষ করে আগামী ৫ ই জানুয়ারী পর্যন্ত কি ভূমিকা গ্রহণ করে এবং কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার ওপর নির্ভর করছে সংকট বা সংঘর্ষের অবসান।
একতরফা নির্বাচন
বনাম নির্বাচন বর্জন
বর্তমান সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কথা বলে আসছেন সে কথা থেকে তিনি এক চুলও নড়েননি। তিনি বলেছেন, সংবিধানের অধীনে অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনের অধীনে নির্বাচন হবে। সেটি হতে যাচ্ছে। তিনি কেয়ার টেকার সরকার বাতিল করতে চেয়েছিলেন। সেটি বাতিল হয়ে গেছে। জাতীয় সংসদকে বহাল রেখেই আরেকটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য তিনি নির্বাচন করতে চেয়েছেন। সেটিই হতে যাচ্ছে। তিনি চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। সেটিও হতে যাচ্ছে। তিনি আরো চেয়েছিলেন যে, ঐ আওয়ামী লীগ সরকার হবে নির্বাচনকালীন সরকার এবং তিনি হবেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। সেটিও হতে যাচ্ছে।
বিএনপির কোন
কথা খাটেনি
পক্ষান্তরে বিএনপি চেয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল থাক। নিদেন পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ মোতাবেক আগামী দুইটি মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে। সেটিও মানা হয়নি। বিএনপি চেয়েছিল, নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ বাতিল হোক। সেই দাবি গ্রহণ করা হয়নি। বিএনপি আরো চেয়েছিল, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান যিনি হবেন তিনি হবেন নিরপেক্ষ লোক। সে দাবিও মানা হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া চেয়েছিলেন, শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকতে পারবেন না। সে দাবী সরকার গ্রহণ করেননি। একটি আলাপ-আলোচনা তথা সংলাপের জন্য বিএনপি দেশী-বিদেশী দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। সেটিও সরকার মানে নি। সবশেষে বিএনপি বলেছিল যে, বড় দুটি দল বা জোটের মধ্যে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচন কমিশন যেন বিরত থাকে। সেটিও মানা হয়নি।
বর্জন ও প্রতিরোধের
হুমকি
২০১০ সাল থেকেই বিএনপি বলে আসছে যে, তাদের দাবি না মানলে তারা পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন শুধু বর্জনই করবে না, সেই নির্বাচন প্রতিরোধও করবে। কিন্তু সে কথাতেও আওয়ামী লীগ সরকার কোন কান দেয়নি। বরং তারা তাদের পরিকল্পনা মত এগিয়ে গেছে। বিএনপি তাদের দাবি থেকে অনেক ছাড় দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামটিও তারা বিসর্জন দিয়েছে। তার বদলে নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলেছেন। কিন্তু এতেও কোন কাজ হয়নি। একটি সংলাপের জন্য তারা মাথা কুটে মরেছে। মির্জা ফখরুল সৈয়দ আশরাফের কাছে চিঠি দিয়েছেন। সৈয়দ আশরাফ সেই চিঠির উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেননি। পরবর্তীতে তিনি আশরাফকে ফোন করেছেন। আশরাফ ফোন ধরেননি। সবশেষে আশরাফের সাথে তিনি বনানীর একটি বাড়িতে গোপনে দেখা করেছেন। সে কথা মির্জা ফখরুল অস্বীকার করেছেন। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ সেটি ফাঁস করে দিয়েছেন। ঐ দিকে বেগম জিয়া উপযাজক হয়ে ২০ জনের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের সাথে দেখা করেছেন। তিনি সংলাপ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছেন। প্রেসিডেন্ট বেগম জিয়ার অনুরোধে কর্ণপাত করেননি। উপরন্তু গত সোমবার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে।
নির্বাচন কি হবে?
নাকি হবে না?
দেশের সচেতন মানুষ বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের মাঝে একটি বিষয় জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা হয়ে ঘোরাফেরা করছে। সেটি হলো, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কি হবে? যারা বলছেন যে নির্বাচন হবে না, তারা মনে করেন যে, মফস্বলে আওয়ামী লীগের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দল যে আন্দোলন করছে তার পরিণতিতে এমন গোলযোগ হবে যে, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন আর হবে না। নির্বাচন না হলে কি হবে? সে প্রশ্নে সঠিক ভাবে কেউ কিছু বলতে পারছেন না।
আবার অনেকে বলছেন যে, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করতে পারবে, কিন্তু প্রতিহত করতে পারবে না। প্রতিহত করা একটি বিশাল ব্যাপার। প্রতিহত করতে গেলে একটি দলের বিশাল ক্যাডার বাহিনী থাকতে হয়। ঐ ক্যাডার বাহিনীতে থাকে প্রধানত সরকারী মাস্তানরা। তবে আওয়ামী লীগ যতবারই ক্ষমতায় এসেছে ততবারই তারা বিশাল এবং দুর্ধর্ষ ক্যাডার বাহিনী পুষেছে। পক্ষান্তরে বিএনপির সেন্ট্রাল লিডারশীপ এবং মধ্য পর্যায়ের নেতৃত্ব হোয়াইট কলার্ড। বিএনপির নেতারা ভদ্রসদ্র হওয়ায় তারা রাজপথে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে পারবে না। তার ওপর এখন পর্যন্ত পুলিশ র্যাব এবং বিজিপি সরকারের পেছনে রয়েছে। বিএনপির ক্যাডাররা কি সরকারের এত বড় ব্যুহ ভেদ করে নির্বাচন বানচাল করতে পারবে?
তবে ওয়াকেবহাল মহল মনে করেন যে, ৬৪ জেলার মধ্যে ৪০টি জেলা এখন সম্পূর্ণভাবে বিরোধী দলের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই ৪০টি জেলায় নির্বাচন কার্যকর ভাবে প্রতিহত হবে।
নির্বাচনের পর
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, নির্বাচন হবে কি না সে ব্যাপারে কেউই চূড়ান্ত কথা বলতে সক্ষম হচ্ছে না। তবে জনমত যে ৭০ শতাংশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সেটি ইতিমধ্যেই জনগণের কথাবার্তা এবং ৪/৫টি নির্বাচনী জরীপে প্রমাণিত হয়ে গেছে। এতদসত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার যদি পেশীশক্তির জোরে নির্বাচন কোন ভাবে পাড়ি দিতে সক্ষম হয় তাহলেও সংকট মিটবে না।
পকিস্তানসহ অন্যান্য দেশে জোর করে যে কারচুপির নির্বাচন হয়েছে তার পরিণতি হয়েছে বড় করুণ। সেই নির্বাচন টেকসই হয়নি। নির্বাচনের পর নবউদ্যমে আন্দোলন হয়েছে এবং সেই আন্দোলনের তোড়ে কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার উড়ে গেছে। বাংলাদেশেও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনের আগে থেকেই সহিংস আন্দোলন চলছে। নির্বাচন কালেও সেটি চলবে। তার পরেও যদি আওয়ামী সরকার পটিয়ে পাটিয়ে ইলেকশন করেই ফেলে তাহলেও ইলেকশনের পর শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।