বাংলাদেশের পোশাককর্মীদের অধিকার রক্ষার তাগিদ দিয়েছেন মার্কিন সিনেটর রবার্ট মেনেন্দেজ। আজ রোববার তাজরিন ফ্যাশনসে অগ্নিকান্ডে ১১২জন পোশাককর্মী নিহত হওয়ার এক বছর পূরণ হওয়ার দিনেই সিএনএন-য়ে তাঁর লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এই নিবন্ধে মেনেন্দেজ এই তাগিদ দেন।
নিউজার্সি থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এই সিনেটর যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান। ওই কমিটি সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাতে শ্রমিক নিরাপত্তা এবং শ্রম অধিকার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
আজ সিএনএন-য়ে প্রকাশিত নিবন্ধে মেনেন্দেজ লিখেছেন, তাজরিন ফ্যাশনসের কারখানায় অগ্নিকান্ডে ১১২ জন নিহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার এক বছর পূরণ হলো আজ। কারখানায় অগ্নিসতর্কতামূলক সাইরেন বাজলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ সেদিন ছিল নির্বিকার। একইসঙ্গে তারা শ্রমিকদের কর্মস্থলে অবস্থান করতে বাধ্য করেছিল।
এর কয়েকমাস বাদেই রানা প্লাজা ধ্বসে ১১৩১ জন শ্রমিক নিহত হন। দুর্ঘটনার আগে ভবনটিকে অনিরাপদ ঘোষণা করা হলেও কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের মজুরি না দেওয়া এবং চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখিয়ে ওই ভবনে কাজ করতে বাধ্য করেছিল। এই জোড়া ট্র্যাজেডি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে কী ভয়ানক পরিবেশে কাজ করে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা সারাবিশ্বের মানুষের জন্য প্রতি বছর দুইশ কোটি ডলারের পোশাক উৎপাদন করে।
মেনেন্দেজ লিখেছেন, বহু আমেরিকানের কাছে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যপ্রান্তের একটি নাম না জানা দেশ। সে কারণে সেখানকার শ্রমিকদের যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় তা তাঁদের কাছে দূরবর্তীই থেকে যায়।
সিনেটর মেনেন্দেজ লিখেছেন, বাংলাদেশে যখন শ্রমিকদের অধিকারকে উপেক্ষা করা হচ্ছে তখন আমরা এই দেশে (যুক্তরাষ্ট্রে) তাঁদের অধিকার পক্ষে সংহতি প্রকাশ করেছি। ১৯১১ সালে ‘ট্রায়াঙ্গল শার্টওয়েইস্ট ফ্যাক্টরি’ নামক পোশাক কারখানায় আগুন লাগার পর যুক্তরাষ্ট্রের কারখানা নিরাপত্তার গুনমানে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল; ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মার্কিন ভোক্তাদের কাছে এই দুটি দুর্ঘটনা একটি জোরালো আহ্বানের মতো।
মেনেন্দেজ লিখেছেন, বাংলাদেশ থেকে আসা পোশাকে যদি শ্রমিকের রক্ত লেগে থাকে তাহলে এদেশের কেউ তা গায়ে চাপাতে চাইবে না। এই দুটি ট্যাজেডির পর আমি বাংলাদেশ থেকে নির্দিষ্ট কিছু পন্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রাধিকারমূলক শুল্কমুক্ত বানিজ্য সুবিধা স্থগিত করতে ওবামা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমাদের সরকার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্স) সুবিধা স্থগিত করে। এরই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ সরকার সেদেশের শ্রমিক অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেয় এবং শ্রমিকদের স্থানীয় ইউনিয়ন গড়ার অনুমতি দিতে থাকে।
আমাদের সরকারের চাপ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলোও বাংলাদেশে অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তার সাধারণ মান প্রতিষ্ঠায় একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে পোশাককর্মীদের ৭৭ শতাংশ বেতন বাড়িয়ে নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সেটি এখনও বিধিবদ্ধ আইনে রুপ পায়নি। এএফএল-সিআইও-এর সলিডারিটি সেন্টার শ্রমিক সংগঠনগুলোকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। শ্রমিক অধিকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকসই ও মজবুজ সংগঠন হিসেবে দাড় করাতে আইএলও একটি প্রকল্প চালু করেছে।
কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি থেকে গেছে। বাংলাদেশে শ্রম ইউনিয়নের ইতিহাস খুব সুখকর নয়। অতীতে শ্রমিক স্বার্থ দেখার পরিবর্তে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবেই শ্রম ইউনিয়নের ব্যবহার হতে দেখা গেছে। এই ধারা থেকে বের হয়ে আসা কঠিন। শ্রম ইউনিয়ন গড়তে শ্রমিকদের নিরাপদ বোধ করাটা জরুরি এবং এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা লোকদের বুঝতে হবে যে শ্রম ইউনিয়ন শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কারখানায় উৎপাদনের ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে।
অতীতের ইতিহাস সুখকর না হওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার ও ক্রেতাদের এ বিষয়টিতে সতর্ক থাকতে হবে।
কিছু কারখানার ম্যানেজার ইউনিয়ন সংগঠকদের হুমকি দেন এবং যাঁরা এ সংগঠনে যোগ দেন তাঁদের নানা ধরনের হুমকি ধামকি দেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। রানা প্লাজা ধ্বসের পর এক ডজনেরও বেশি শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
আমাদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে পরিবর্তন আনার বিশাল সুযোগও রয়েছে।
প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক থাকতে হবে এবং শ্রম আইন ঠিকমতো সংশোধন ও মানা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শ্রম সংগঠকদের শ্রমসংগঠন-বিরুদ্ধ কার্যকলাপ থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। এ ধরনের প্রচেষ্টার জন্য অর্থ সাহায্য বাড়ানোর প্রচেষ্টা রাখতে হবে। আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনের সলিডারিটি সেন্টার কর্মসূচির মতো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে শ্রমিক সংঘবদ্ধভাবে তাদের দাবিদাওয়া ও সুযোগ ভোগ করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ সরকার এবং গার্মেন্টস মালিক সমিতিকে দ্রুততার সঙ্গে শ্রম ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি নিতে হবে এবং তার প্রয়োগ করতে হবে।
সর্বশেষ, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সরবরাহকারী কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদের জীবনমান নিশ্চিত করতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী নিতে পারে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় এবং শ্রমিক-ব্যবস্থাপক সম্পর্ক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গঠনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। যারা ইউনিয়নের বিপক্ষে কাজ করবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার মতো অবস্থান গড়ে তুলবে।
দক্ষ শ্রমশক্তি, নিরাপদ কারখানা গড়ে তুলতে সরকার, অ্যাপারেল কোম্পানি, দেশী কারখানার মালিক, সংগঠিত শ্রমিক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা প্রয়োজন পড়বে। কিছুটা সময় হয়তো লাগবে কিন্তু এক্ষেত্রে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো পথ খোলা নেই।
মেনেন্দেজ লিখেছেন, এক বছর আগে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অনিরাপদ কর্মপরিবেশের কারণে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনায় সারা বিশ্ব কেঁদে উঠেছিল। আমাদের জন্য পোশাক তৈরি করতে গিয়ে সেই নিহত শ্রমিক এবং বাংলাদেশের ৪০ লাখ শ্রমজীবী গার্মেন্টস কর্মীর কাছে ঋণী রয়ে গেছি। যতদিন না পর্যন্ত তাঁদের ন্যায্য অধিকার এবং তাদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত আমরা চাপ প্রয়োগ করেই যাব।