সরকারের মনোবলে চিড় ধরেছে

0
270
Print Friendly, PDF & Email

নির্বাচন নিয়ে সরকারের মনোবলে চিড় ধরেছে। সরকার চাচ্ছে না একতরফার কোন নির্বাচন। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় বিরোধী দলের কঠোর অবস্থান সরকারকে নমনীয় হতে বাধ্য করছে। তদুপরি, সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলের নানা ধরনের চাপ। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন চাচ্ছেন একটি সমঝোতা; তেমনি নির্বাচন কমিশনও একটি সমঝোতার প্রত্যাশায় তফসিল ঘোষণার দিনক্ষণ পিছিয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- শেষ পর্যন্ত সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়ানো যাবে তো?
এদিকে, সরকারের অভ্যন্তরে হার্ড লাইনার হিসেবে চিহ্নিতরা চাচ্ছেন আওয়ামী লীগকে একতরফা নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে। এদের উদ্দেশ্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ‘নার্ভ টেস্ট’ করা। তারা দেখতে চায়- নির্বাচন প্রতিহত করার মত কি ধরনের রণকৌশল সাজিয়েছে বিএনপি। তাদের মতে, বিএনপি’র আন্দোলনের উপর নির্ভর করবে ‘নির্দলীয় সরকার’ এর দাবি মানা না মানার বিষয়টি। তবে সরকারের অভ্যন্তরে ‘উদারপন্থী’ হিসেবে চিহ্নিতরা অনেক আগে থেকেই সংলাপের মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিয়ে আসছে। এই অবস্থায় কঠিন পরীক্ষার মুখে বিরোধী দলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কি পারবেন নির্বাচন প্রতিহত করার মত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে?
সরকার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের নির্বাচন প্রতিহত করার এই ঘোষণাকে মোটেও হালকাভাবে নেয়নি। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মাঠ প্রশাসনে কঠোর নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে-বিরোধী দলকে কোন ধরনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে না দেয়া; ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা জোরদার করা; প্রার্থীদের নিরাপত্তা জোরদার করা এবং তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক ধরপাকড় করা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সকল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জোরালোভাবে মনিটর করা এবং মোবাইল ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে আন্দোলনকারী নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকারের এমন কঠোর অবস্থানকে বিএনপি কিভাবে মোকাবেলা করবে-তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে নানা ধরনের আলোচনা। কেউ বলছেন সরকার যত কঠোরই হোক না কেন; বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ঠিকই দেশজুড়ে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবে। আবার অনেকেই বলছেন, বিএনপি তিন দফায় লাগাতার হরতাল কর্মসূচি দিলেও মাঠ পর্যায়ে নেতাদের অনুপস্থিতির কারণে খোদ বেগম খালেদা জিয়াই ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
এরকম পরিস্থিতির মধ্যেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করার নানামুখী কর্মসূচি নিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-দেশব্যাপী অবরোধ ও হরতাল। অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ভোটের বাক্স, ব্যালট পেপারসহ ভোটের সামগ্রী পরিবহন ও নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রমকে ব্যাহত করা; ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন বিমুখতা সৃষ্টি; পোলিং অফিসার, সহকারী পোলিং অফিসার এবং ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান করা। এ জন্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট মহাসড়ক, জেলা-উপজেলা সড়ক, নৌ-পথ, রেলপথ, জেলা-উপজেলা প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন অফিস ঘেরার ও অবরোধ করার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে। এতেও নির্বাচন প্রতিহত না হলে তারা ভোটের দিন প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি সর্ব নিম্ন পর্যায়ে রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে বলে জানা গেছে।
সরকার ও বিরোধী দলের এরকম কঠোর অবস্থানে সবচেয়ে বেকায়দায় রয়েছেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। মাঠ প্রশাসনে অনেকের সাথে আলোচনা করে জানা গেছে, তারা সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলের আন্দোলন প্রতিহত করতে অনেক কঠোর নির্দেশনা পেয়েছেন। তবে এসব নির্দেশনা পেলেও মাঠ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই বলেছেন, তারা এখনও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যব্ক্ষেণ করছে। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সচিব জানান, নির্বাচনকে ঘিরে দেশজুড়ে সংঘাত-সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করলে প্রশাসন ‘ডিজ অর্ডার’ হয়ে যেতে পারে। এই সচিবের মতে, এ নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরেও রয়েছে না ধরনের সন্দেহ-সংশয়। কার্যত একতরফা নির্বাচন করা নিয়ে ভেতরে ভেতরে সরকার ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাচ্ছেন বিরোধী দলকে নিয়েই নির্বাচন করতে। তবে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থান স্পষ্ট- শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে তার দল নির্বাচনে যাবে না। তবে বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য হবে না তা নিয়ে কথা বলেছেন সর্বদলীয় সরকারে ঠাঁই পাওয়া ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তিনি গতকাল রবিবার মন্ত্রণালয়ে এসেই সাংবাদিকদের বলেছেন, অধিকাংশ জনগণ অংশ গ্রহণ করলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে। অন্যথায় তা গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে নির্বাচন যেমন অপরিহার্য; তেমনি নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণও অপরিহার্য। তিনি আরও বলেন, এর আগে ’৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি এবং ’৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ অংশ না নেওয়ায় তা প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে আমরা বিরোধী দলকে বারবার আহ্বান জানাচ্ছি।
এদিকে, জাতীয় পার্টি সরকারের একতরফা নির্বাচনের হাতিয়ারে পরিণত হলেও বিএনপি তাতে মোটেও বিচলিত নয়। অতীতেও বিএনপি’কে নির্বাচনে আনতে নানা প্রলোভন, ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে। রাজনৈতিক ঢেউয়ের ঝাপটায় ছত্রখান হওয়ার দশা হয়েছে তার জীবনে বহুবার। কিন্তু তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। বরং বিপদসঙ্কুল মুহূর্তে তিনি রাজপথে নেমে এসেছেন। পতনের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়েও এগিয়ে গেছেন। ছিনিয়ে এনেছেন বিজয় গাঁথা। গ্রেফতার, হামলা, মামলা, তার আন্দোলনমুখী মনোভাবে মোটেও চিড় ধরাতে পারেনি। এবারও তার আপোষহীন মনোভাব সরকারকে বিচলিত করে তুলেছে। আর সে কারণেই শেষ পর্যন্ত সরকার চাচ্ছে- একটা আপোষরফার মাধ্যমে সকল দলের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে।
তবে এই পরিবেশ সৃষ্টি না হলে ’৯৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজন করতে যে পথে হেঁটেছে আওয়ামী লীগ; ঠিক একই পথে হেঁটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সংবিধানে পুনঃস্থাপনের কর্মসূচি নিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড।

শেয়ার করুন