চার দিনেরও বেশি সময় ধরে দফায় দফায় আলোচনা ও দর কষাকষির পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন রাশিয়া ও জার্মানির সঙ্গে রোববার প্রথম প্রহরে ইরানের এই সমঝোতা হয়।
জেনেভায় ওই বৈঠকের পর আন্তর্জাতিক পক্ষের প্রধান মধ্যস্থতাকারী ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্র প্রধান ক্যাথেরিন অ্যস্টন বলেছেন, ব্যাপক একটি সমাধানের পথে “প্রথম পদক্ষেপের” বিষয়ে তারা একটি সমঝোতায় পৌঁছেছেন।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ এক টুইটে বলেন, “আমরা একটি চুক্তিতে পৌঁছেছি।”
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরাঁ ফ্যাবিয়াসও সমঝোতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, রাশিয়ার সের্গেই ল্যাভরভ ও ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগও এই বৈঠকে অংশ নেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা চুক্তিটিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন এটি ইরানকে নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখবে।
তবে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবী করেছেন, এই চুক্তির পরও ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অধিকার অক্ষুণ্ণ আছে।
তাৎক্ষণিকভাবে চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করা না হলেও এর মধ্য দিয়ে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘ এক দশকের স্নায়ুক্ষয়ী বিরোধের অবসান ঘটবে বলেই আশা করছেন বিশ্লেষকরা।
বৈঠকের আগে সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিদিয়ের বুরখাল্টার ও ইরানের জাভেদ জারিফ করমর্দন
২০০২ সালে ইরানের গোপন নিউক্লিয়ার কর্মসূচীর কথা জনসম্মুখে প্রকাশ পায়। ওই সময় বিরোধী একটি দল ইরানের নাতাঞ্জে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের গোপন তৎপরতা ও আরাকে ভারী-পানির চুল্লির কথা প্রকাশ করে দেয়।
এর পরপরই পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে আসছে বলে পশ্চিমা দেশগুলো জোরালো অভিযোগ তোলে। বিপরীতে ইরান দাবি করে, কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যই তাদের এই পরমাণু প্রকল্প।
নিজেদের নিউক্লিয়ার প্রকল্পগুলো পরিদর্শনের জন্য আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশনের (আইএইএ) পরিদর্শকদের অনুমতি দিতে রাজি জয় ইরান। প্রকল্পগুলো পরিদর্শনের পরও ইরানের প্রকল্পগুলো শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে নিয়োজিত কিনা সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিরা।
এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করায় চাপ সৃষ্টির দিকে নিয়ে যায়। নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যেই ইরান প্রকল্পগুলো চালাচ্ছে বলে সন্দেহ বদ্ধমূল হয় পশ্চিমা শক্তিগুলোর।
এই নিয়ে গত এক দশক ধরে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের বিরোধ চলে আসছে। ইরানের নিউক্লিয়ার কার্যক্রম থামানোর জন্য দেশটির নিউক্লিয়ার প্রকল্পগুলোতে হামলা চালানোর দাবীও ওঠে পশ্চিমা বিশ্বে। ইরানের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিবেশি ইসরায়েল বেশ কয়েকবার ইরানে হামলা চালানোর হুমকি দেয়।
এই পরিস্থিতিতে গত অগাস্টে হাসান রুহানি ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ শুরু করেন। এরই ফল গত মাসে পরমাণু প্রকল্প নিয়ে ছয় বিশ্ব শক্তির সঙ্গে ইরানের আলোচনা আবার শুরু হয়।
এই ছয় দেশকে একসঙ্গে বলা হচ্ছে ‘পি৫+১’, অর্থাৎ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানি।
এর আগে চলতি বছরের শূরুতে জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় এই ছয় দেশের সঙ্গে ইরানের বৈঠক হলেও তা ব্যর্থ হয়।
পশ্চিমা বিশ্বের দাবি ছিল, ইরানকে তাদের ইউরেনিয়াম পরিশোধনের মাত্রা ২০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কারণ সেক্ষেত্রে তারা ওই ইউরেনিয়াম আর বোমা বানানোর কাজে ব্যবহার করতে পারবে না। তবে ইরান এতোদিন তাদের কর্মসূচি থেকৈ পিছু হঠতে রাজি হয়নি।
২০০৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যারা ইরানের পরমাণু প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত, তাদের সম্পদ জব্দ এবং ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এছাড়া তেলভিত্তিক অর্থনীতির দেশ ইরানের শক্তি এবং ব্যাংকিং খাতেও বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এবার সমঝোতার মধ্য দিয়ে সেসব নিষেধাজ্ঞা শিথিল হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।