সংঘাত আসন্ন? তফসিল বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্ত আজ

0
154
Print Friendly, PDF & Email

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, সরকারপক্ষ ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি ততই আসন্ন হয়ে উঠছে। কারণ নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা গেছে, বিরোধী দল নির্বাচনে আসুক বা না আসুক আজ অথবা কালকের মধ্যেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে। আর নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনবিরোধী কোনো আন্দোলন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। অথচ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিচ্ছে, একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণামাত্র দেশ অচল করে দেওয়া হবে। লাগাতার হরতাল, অবরোধ, ইসি কার্যালয় ঘেরাওসহ সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এমনকি একতরফা নির্বাচন প্রতিহতের জন্য সারা দেশে আসনভিত্তিক আন্দোলনের প্রস্তুতিও নিয়েছে বিরোধী দল। কিন্তু সরকার ও ইসির পক্ষ থেকে নির্বাচনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড বরদাস্ত করা হবে না বলেও কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় আসন্ন নির্বাচনের আগে সংঘাতই আসন্ন হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আসন্ন সংঘাতময় পরিস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ‘সর্বদলীয়’ সরকারের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন তাদের আইন অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। এর আগে সিটি করপোরেশনসহ সবগুলো নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। আশা করি, জাতীয় নির্বাচনও সেভাবেই হবে।’

ওদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধিতে অনেক কিছু থাকতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আমাদের দাবি মানছে না। এই কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ। আমাদের আন্দোলন ছাড়া বিকল্প পথ নেই। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার দাবিতে নির্বাচন প্রতিহত করবে দেশের মানুষ। এখানে সংঘাত হওয়ার কিছু নেই। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী। সরকার তাদের পেটোয়া বাহিনী দিয়েই সন্ত্রাস ও সংঘাত-সংঘর্ষ করছে আর বিরোধী দলের ওপর সব দোষ চাপাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তবে নির্বাচনী আইন প্রয়োগ করা কতদূর সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, এ আইন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব। সাধারণত ভোটের দিন এটা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। কিন্তু দেশের একটি বৃহৎ দল যখন নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনে নামবে, তখন কত জনের বিরুদ্ধে এটা প্রয়োগ করা যাবে? হরতাল -অবরোধ বন্ধের কী ব্যবস্থা হবে? সরকার তো তাদের আন্দোলন বন্ধের জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ ঘটিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু আন্দোলন কি বন্ধ হয়েছে? সে কারণে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টির সমাধান না হলে সংঘাত আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন আজ রবিবার দশম সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি বা তফসিল নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। কবে তফসিল ঘোষণা হবে, তফসিল ঘোষণার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন কি না সে বিষয়টি সম্পর্কে আজ কমিশন বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। গত শুক্রবার নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ নির্বাচনী তফসিল সোমবারের মধ্যে ঘোষণা হতে পারে মর্মে চাঁদপুরে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানালেও অন্য নির্বাচন কমিশনাররা বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেননি। ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে এমনও ধারণা রয়েছে যে, সংশোধিত নির্বাচনী আচরণ বিধিমালার জন্য আইন মন্ত্রণালয় থেকে এসআরও নম্বর সংগ্রহের পর তা গেজেট আকারে প্রকাশের পরই আজ বিকেলেই তফসিল ঘোষণা হতে পারে। দ্রুত ওই এসআরও নম্বরটি সংগ্রহের জন্য আজ সকালেই একজন নির্বাচন কর্মকর্তা আইন মন্ত্রণালয়ে যাবেন। কিন্তু ইসি সূত্র জানায়, আজই আচরণবিধি প্রকাশ করে আজই তফসিল ঘোষণার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনাররা দ্বিধান্বিত। সে ক্ষেত্রে আগামীকাল সোমবারই তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা বেশি।

এদিকে দুইজন নির্বাচন কমিশনার গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে জানান, তফসিল ঘোষণার পর প্রধান বিরোধী দল ও তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের বর্তমান আন্দোলন কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা নির্বাচনী আইন অনুসারে অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ দলগুলোর নেতারা এ বিষয়ে কোনো সভা-সমাবেশেরও অনুমতি পাবেন না। অন্য দলগুলোও নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে নির্বাচনী আচরণ বিধির আওতায় আসবে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৭৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন প্রতিহত করার শাস্তি অর্থদণ্ডসহ দুই বছর থেকে সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড। এ ছাড়া নির্বাচনী আচরণ বিধিমালার ৬ ধারা অনুসারেও এ ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি পালনের চেষ্টা অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত।

নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল মোবারক গতকাল এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী আইন অনুসারে যেকোনো সভা-সমাবেশ, মিছিল- এসবের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ভোটগ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিনের তিন সপ্তাহ সময়ের আগে নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করা যাবে না। তিন সপ্তাহ সময়ের মধ্যেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নির্বাচনী জনসভা বা সমাবেশ করা যাবে না।

আব্দুল মোবারক জানান, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও তফসিল ঘোষণার পর বিরোধীদলীয় নেতা এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদকে ওই নির্বাচনী এলাকায় সফর ও সমাবেশে যোগ দিতে না যাওয়ার জন্য ইসির পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল এবং সে অনুরোধ তাঁরা রক্ষা করেন।

নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ এ বিষয়ে গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনবিরোধী প্রচারণা বেআইনি হিসেবেই গণ্য হবে। নির্বাচনবিরোধী তৎপরতা এত দিন যা হয়েছে, তাও গ্রহণযোগ্য নয়। হরতালের নামে সম্পদের ক্ষতি, মানুষ পুড়িয়ে মারা প্রচলিত আইনের দৃষ্টিতেও অপরাধ। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশ অচল করে দেওয়ার যে হুমকি বিরোধী দলের কাছ থেকে এসেছে, তাও কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশনা দেব।’

মোহাম্মদ আবু হাফিজ আরো বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও যাতে নির্বাচনী আচরণ মেনে চলেন সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও আমরা কথা বলেছি। নির্বাচনকালীন যে মন্ত্রিসভা হয়েছে, সেটা শুধু রুটিন কাজ করবে। নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। গত ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সময়ে সংযত আচরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।’

তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের সময় বা নির্বাচনী সময়ে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীদের প্রটোকল ও প্রটেকশন সম্পর্কে আবু হাফিজ বলেন, এ ক্ষেত্রে আলাদা আইন রয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে তাঁরা সরকারি যানবাহনসহ অন্যান্য সুবিধা না পেলেও প্রটোকল, প্রটেকশন পাবেন।

নির্বাচনী আচরণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তাঁর নির্বাচনী এলাকায় সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্তৃত্ব কিংবা এ-সংক্রান্ত সভায় যোগ দিতে পারবেন না। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে থাকলে নির্বাচনের সময় তা অকার্যকর থাকবে। সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভোট দেওয়া ছাড়া নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ কিংবা নিজে প্রার্থী না হলে ভোট গণনার সময় গণনা-কক্ষে প্রবেশ বা উপস্থিত থাকতে পারবেন না। এ সময় কোনো সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রাজস্ব বা উন্নয়ন তহবিলভুক্ত কোনো প্রকল্পের অনুমোদন, ঘোষণা বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কিংবা ফলক উন্মোচন করা যাবে না।

নির্বাচনী সময়ে কোনো সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি স্বেচ্ছাধীন সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কোনো প্রকার অনুদান ঘোষণা বা বরাদ্দ দিতে বা অর্থ অবমুক্ত করতে পারবেন না।

এদিকে নির্বাচন কমিশনাররা জানিয়েছেন, নির্বাচনে এবারও সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের ধারণা, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করতে গেলে কিছুটা সমস্যা হবে।

সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল মোবারকের পাল্টা প্রশ্ন- বাংলাদেশের কোন নির্বাচনে, কোন সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হয়নি? তিনি বলেন, এবারও সেনা মোতায়েন থাকবে। ২০০১ ও ২০০৮ সালের আগে যেভাবে হয়েছিল, সেভাবেই সেনা মোতায়েন করা হবে।

অন্য এক কমিশনার বলেন, ক্ষমতাসীন দলের অনেক সংসদ সদস্য হয়তো এবার দল থেকে মনোনয়ন পাবেন না। সে ক্ষেত্রে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে তা ক্ষমতাসীন দলের জন্যই সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

শেয়ার করুন