সংবিধান নিয়ে স্বেচ্ছাচার

0
166
Print Friendly, PDF & Email

দেশের সংবিধান নিয়ে চলছে স্বেচ্ছাচার। যথেচ্ছ কাটাছেঁড়ার পর এখন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও দেয়া হচ্ছে খেয়ালখুশি মতো। সংবিধানের প্রস্তাবনাসহ ৫৭টি অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের অযোগ্য থাকলেও আওয়ামী লীগ আমলের বর্তমান সময়ে যথেষ্ট পরিবর্তনের পর ভবিষ্যতের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সংবিধানে সংশোধনী এনেছে সর্বোচ্চ পাঁচটি। আওয়ামী লীগের আনা এসব সংশোধনীতে সংবিধানে সবচেয়ে বেশি কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অর্ধশতাধিক বিষয় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, আওয়ামী লীগ চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় সরকার কায়েম করেছিল। তার ৩৬ বছর পর যে সংশোধনী আনা হয়েছে তার সাথে আগের সংশোধনীর গুণগত তেমন পার্থক্য নেই। এই সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের মতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশের সংবিধানে যে ১৫টি সংশোধনী আনা হয় তার প্রথম চারটি আনা হয় স্বাধীনতার পরপরই মতায় আসা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়। আওয়ামী লীগের অধীনে আর একটি সংশোধনী আনা হয় ২০১২ সালে, যা দেশের সংবিধানে সর্বশেষ সংশোধনী। মাঝখানে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আরো একবার সরকার পরিচালনা করেছে। কিন্তু সেবার সংবিধান সংশোধনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের ছিল না। দেখা গেছে, যে দুইবার আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তখনই তারা সংবিধানে হাত দিয়েছে। আর তারা সবসময়ই সেটা করেছে নিজেদের মতো করে। কারো মতের তোয়াক্কা করা হয়নি এসব সংশোধনীর সময়। সর্বশেষ সংশোধনীর েেত্র বিভিন্ন পরে মতামত নেয়া হলেও কারো মতামতেরই প্রতিফলন দেখা যায়নি সংবিধানের সংশোধনীতে। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সংবিধান সংশোধনীর েেত্র দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করা যাবে। ১৯৭৭ সালের দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধনী আদেশ) অনুযায়ী সংবিধানের মূলনীতি ও মৌলিক চরিত্রসংক্রান্ত ৮, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০, ৯২(ক) অনুচ্ছেদসমূহ পরিবর্তনের েেত্র অবশ্যই গণভোট প্রয়োজন হবে। ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীতে ৫৮, ৮০ ও ৯২ অনুচ্ছেদকে গণভোটের আওতামুক্ত করা হয়। তবে মূলনীতিসংক্রান্ত ৮, ৪৮ ও ৫৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হলে গণভোটের প্রয়োজন বহাল রাখা হয়। কিন্তু ২০১২ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনে সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাবনাসহ ৫৭টি অনুচ্ছেদের বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে সংবিধানে নতুন কোনো পরিবর্তন কিংবা সংশোধনের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া সংবিধানের বিধানের বিপে বলা কিংবা আচরণ, বিদ্বেষ সৃষ্টি হতে পারে এমন কিছু শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও খ্যাতিমান আইনজীবী ড. কামাল হোসেন সম্প্রতি এক আলোচনা অনুষ্ঠানে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণ বলে উল্লেখ করেন। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক আলোচনা সভায় ড. কামাল হোসেন বলেন, তড়িঘড়ি করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্ম দেয়া হয়েছে। সরকার তত্ত্বাবধায়ক সম্পর্কিত আদালতের রায়ের একটি অংশ মানলেও অন্য অংশটি মানেনি। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগ যতবারই সুযোগ পেয়েছে, ততবারই সংবিধান সংশোধন করেছে তাদের বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। মতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য। জনগণের কল্যাণে তারা কখনোই সংবিধান পরিবর্তন করেনি। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মীমাংসিত বিষয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে সরকার দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের আনা সংশোধনীগুলো দেশে বরাবরই বড় ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে চতুর্থ সংশোধনীর সময় দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। দীর্ঘ বিরতির পর পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবার ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সম্প্রতি নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, চতুর্থ সংশোধনী আর পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ নেই। তখন (চতুর্থ সংশোধনীর সময়) একদলীয় সরকার কায়েম করা হয়েছিল। আর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে এমন কতগুলো বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যার মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। এ সংশোধনীতে সংবিধানের কতগুলো ধারা অসংশোধনযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত সংসদের সার্বভৌমত্ব ুণœ করা হয়েছে। তিনি বলেন, সংসদ তো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। তাহলে জনগণের সার্বভৌমত্ব থাকল না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে করা সংশোধনীগুলো বিশেষ করে চতুর্থ ও পঞ্চদশ সংশোধনী জনগণের কল্যাণে করা হয়নি। জনগণের মৌলিক অধিকারকে অবজ্ঞা করে এসব সংশোধনী করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মূলত আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। এটি ফ্যাসিবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। তাদের মাইন্ডসেট এমন যে, কেবল তারাই ক্ষমতায় থাকবে, রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। এটা থেকে তারা বেরুতে পারছে না। ফলে তারা যখনই সংবিধান সংশোধন করে তখনই তা এমনভাবে করে, যাতে দেশে বারবার রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, পঞ্চদশ সংশোধনীতে কেবল প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকেই স্থায়ী করা হয়নি। এমন স্থায়িত্ব দেয়া হয়েছে অন্য মন্ত্রীদের পাশাপাশি সংসদ সদস্যদের ক্ষমতার ক্ষেত্রেও। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পার্লামেন্টের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে। কারণ সংবিধানে ৭-খ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে প্রায় অর্ধশত অনুচ্ছেদকে অসংশোধনযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে প্রগতিশীলতার সাথে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। কিন্তু এ অধিকার তাদের নেই। তা ছাড়া এ সংশোধন অব্যাহত থাকলে জাতীয় নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে না। কারণ নতুন সংশোধনের ফলে একজন নির্বাচন করবেন এমপি হিসেবে এবং অন্যদের নন-এমপি হিসেবে নির্বাচন করতে হবে। এতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে না। এর একটি প্রভাব নির্বাচনে পড়বে। ফলে নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৪-ক অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সব সরকারি, আধা-সরকারি অফিসে সংরণ ও প্রদর্শন করিতে হইবে।’ পৃথিবীর অনেক দেশেই নিজ নিজ দেশ কর্তৃক স্বীকৃত জাতির জনক বা পিতা আছেন এবং তারা সবাই নিজ নিজ দেশে সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু কোনো দেশের সংবিধানে দেশের জনকের নাম উল্লেখ খুঁজে পাওয়া যায় না। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে বাদ দেয়া হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। অথচ দেশে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা হিসেবে এটি ছিল একটি মীমাংসিত বিষয়। সংশোধনের সময় বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি সত্ত্বেও তা বাতিল করে দেয়া হয়। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে এক বিরাট অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ আমলে আনা হয় আরো তিনটি সংশোধনী। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে আনা প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৭ অনুচ্ছেদে দু’টি নতুন উপধারা সংযোজন করা হয়। এ সংশোধনীর মূল কারণ ছিলÑ গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য আইন তৈরি ও কার্যকর করা। ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হয়, যার মাধ্যমে সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদে (২৬, ৬৩, ৭২ ও ১৪২) সংশোধন আনা হয়। নিবর্তনমূলক আটক, জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং এ সময় মৌলিক অধিকারগুলো স্থগিতকরণ সম্পর্কে প্রথম দিকে সংবিধানে কোনো বিধান ছিল না। এ সংশোধনীর মাধ্যমে বিধানগুলো সংযোজন করা হয়। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের সীমানানির্ধারণী একটি চুক্তি বাস্তবায়ন করার জন্য ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর আনা হয় সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী। ভারতের কিছু অংশ বাংলাদেশে আসবে এবং বাংলাদেশের কিছু অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবেÑ এ চুক্তি বাস্তবায়নের জন্যই তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়। এই সংশোধনী অনুসারে বাংলাদেশ ভারতকে তার ভূখণ্ড হস্তান্তর করলেও ভারত আজ পর্যন্ত ওই চুক্তিতে করা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ও দেশের সংবিধানে সর্বোচ্চ পাঁচটি সংশোধনী আনা হয়েছে। পঞ্চম, একাদশ, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ সংশোধনী আনে চার মেয়াদের বিএনপি সরকার। তবে আওয়ামী লীগের সময় পাঁচটি সংশোধনী আনা হলেও মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি সেসব সংশোধনীতে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের সময় ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল ও বর্তমান ক্ষমতাসীনদের দাবির মুখে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করা হয়। অথচ যাদের দাবির মুখে এই সংশোধনী আনা হয় তারাই বর্তমানে ক্ষমতায় গিয়ে সে সংশোধনী বাতিল করে। বিএনপি সরকারের আনা অন্য সংশোধনীগুলোতে দেশে বড় কোনো রাজনৈতিক সঙ্কটেরও সৃষ্টি হয়নি। এ ছাড়া সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলসহ বিভিন্ন মেয়াদে সংবিধানে আরো পাঁচটি সংশোধনী আনা হয়। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, সংবিধানে সংশোধনী আনা হয় জনগণের কল্যাণে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংবিধানে সংশোধনী এনে একটি অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ১৯৭৫ সালে তারা দেশে একদলীয় সরকার কায়েম করেছিল। সংবাদপত্র, রাজনৈতিক দল, এমনকি বিচার বিভাগকেও তারা কুক্ষিগত করেছিল। পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে দেশে রাজনৈতিক দল গঠন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় এসে আবার সংবিধান সংশোধন করল। তাদের আন্দোলনের মুখে সংবিধানে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংযোজন করা হলো, সেই ব্যবস্থাই তারা এবার বাদ দিলো। এর মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় থেকে একটি বিতর্কিত নির্বাচন করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। সাবেক বিচারক ও খ্যাতিমান সংবিধান বিশ্লেষক ইকতেদার আহমেদ এ প্রসঙ্গে জানান, সংবিধানের কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মনগড়া দিলে হবে না। সংবিধানের বিধানাবলির আলোকেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে হবে। এর একটি বিধানের সাথে অপর বিধান সম্পর্কযুক্ত। খণ্ডিত অধ্যয়নের মাধ্যমে সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদান বাস্তবসম্মত নয়। সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা দিতে হলে এ অনুচ্ছেদ সংশ্লেষে অন্যান্য অনুচ্ছেদে যে বিধানাবলি রয়েছে তা দেখেই ব্যাখ্যা প্রদান সমীচীন।

শেয়ার করুন