বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ন্যক্কারজনক খেলায় মেতে উঠেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের মতামতের তোয়াক্কা না করে দেশটি প্রধান প্রধান বিরোধী দলবিহীন একটি প্রহসনের নির্বাচনে মদত দিয়ে যাচ্ছে। বিদায়ী মহাজোট সরকারের কাছ থেকে গত ৫ বছরে ব্যাপক সুবিধা গ্রহণের প্রতিদান হিসেবে আওয়ামী লীগকে আরেকবার ক্ষমতায় বসাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের বৃহত্ প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে ঢাকায় নিয়োজিত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের গোপন বৈঠকের পর বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে। ওই বৈঠকের পর ভারতীয় কূটনীতিকরা কোন রাখঢাক না করে প্রকাশ্য তত্পরতায় নেমেছেন। তাদের আশকারায় ক্ষমতার শেষ প্রান্তে এসেও সরকার বেপরোয়া আচরণ করছে। হত্যা, অত্যাচার, নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাচ্ছে বিরোধী শিবিরের ওপর। পর্যবেক্ষকরা এ পরিস্থিতিকে নজিরবিহীন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
সর্বশেষ ভারত একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে লোক দেখানো একটি বিবৃতি দিলেও পর্দার আড়ালে তারা একতরফা নির্বাচনকে উসকে দিচ্ছে বলে জানা গেছে। কূটনীতিক শিষ্টাচার ও রীতিনীতি লঙ্ঘন করে গোপন বৈঠক করছে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে।
মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনের পলিটিক্যাল কাউন্সিলর মনোজ কুমার মহাপাত্রের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিকাল পৌনে চারটায় শুরু হওয়া দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে ইসির অবস্থান, নির্বাচনের দিনক্ষণ, প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ করা না করা, নির্বাচনী বিভিন্ন কৌশল, বিএনপি না এলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার উপায়সহ নানা বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে বলে বৈঠকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ইসির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সম্ভাব্য ভোটের তারিখ, নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ, ইসির সক্ষমতা, সামগ্রিক নির্বাচনে ভারতের সহযোগিতা লাগবে কিনা ও প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে আসার বিষয়ে ইসির পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কিনা এসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভারত সরকার সার্বিক সহযোগিতা করবে বলেও সিইসিকে আশস্ত করেছেন মনোজ কুমার মহাপাত্র।
এদিকে সোমবার চলমান সঙ্কট নিয়ে ভারত একটি বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে বলা হয়, সংলাপ এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশের চলমান সমস্যার সমাধান চায় ভারত। বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা দেয়ার কথাও বলে ভারত।
বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সৃষ্ট সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রথমবারের মতো দেয়া ওই বিবৃতিতে ভারত তাদের অবস্থান তুলে ধরে।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা একের পর এক উদ্বেগ জানিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানালেও প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় দিল্লি।
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে পাঠানো বিবৃতি বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যত্ নির্ধারণ করবে। ভারত বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সমর্থন জানাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের মতো একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশে সংলাপ এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে মতপার্থক্যগুলো সমাধান করা উচিত। আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের শান্তি স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।
প্রসঙ্গত, বেশ কিছুদিন ধরে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারতের একতরফা সমর্থনের বিষয়টি বেশ জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে ভারত দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে এবং আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে চায় ভারত—এমন খবর বার বার এসেছে গণমাধ্যমে। ভারতের এই অবস্থানের ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও তৈরি হয়েছে। সব জনমত জরিপে এগিয়ে থাকা বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তার এ বক্তব্যের আগে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুনীল কুমার শিনধে বলেছেন, শেখ হাসিনা আমাদের আপনজন। ভারত অবশ্যই তাকে প্রতিদান দেবে। সব মিলিয়ে ভারতের এই একচোখা নীতির ব্যাপারে দেশে সমালোচনা জোরদার হচ্ছে।
এর আগে বর্তমান সরকারের অবস্থানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে দূতিয়ালি করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। গত সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে মনমোহন সিং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে তার উদ্বেগের কথা জানান। মনমোহন সিংয়ের ওই উদ্বেগের প্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার পররাষ্ট্র কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে পরামর্শ বাড়ানোর আদেশ দেন। তিনি এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র কর্মকর্তাদের নয়াদিল্লির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে বলেছেন বলে ভারতের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা পিটিআইকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদন ছেপেছে ইকোনমিক টাইমস। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনার নয়াদিল্লি সফরও ওই প্রক্রিয়ারই অংশ বলে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়।
ওবামার নির্দেশের পর বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুসান রাইস ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের সঙ্গে আলোচনা করেন বলেও জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে জানিয়ে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। আর নির্বাচনের ফলাফল কী হবে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই।
এছাড়া বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা সভা করে হাসিনা সরকারের একগুঁয়ে অবস্থানকে সমর্থন করতেও দেখা যাচ্ছে দিল্লিকে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র আরও বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় বলা হয়, অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে হলে ভারতের বিশালত্বকে ‘সুবিধাজনক’ দৃষ্টিতে দেখার পাশাপাশি বাংলাদেশকে ধর্মীয় মৌলবাদের মোকাবিলাও শক্ত হাতে করতে হবে। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শ্যামশরণ এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত দুই সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ও পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ওই আলোচনা সভায় বেশ খোলামেলাভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুরে সুর মেলান। তারা বলেন, বাংলাদেশ এখন যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে মৌলবাদের মোকাবিলাই তাদের রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা ঠিকমত করতে না পারলে কয়েক বছর ধরে উন্নয়নের যে ধারা অব্যাহত আছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলও অশান্ত হয়ে উঠবে। দ্য সোসাইটি ফর পলিসি স্ট্যাডিজ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত এ গোলটেবিল আলোচনায় বাংলাদেশ থেকেও কয়েকজন আওয়ামী বুদ্ধিজীবী যোগ দেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কী করতে পারে না পারে তার ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়েছে দিল্লিতে। গোলটেবিল আলোচনায় বাংলাদেশের বিদ্যমান টালমাটাল অবস্থায় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন ভারতীয় কূটনীতিকরা। পিনাক বলেন, এ প্রবণতা দূরীকরণে জাতিসংঘের অবদান প্রবল। তাদের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশী সেনাদের অংশগ্রহণের আগ্রহ এর কৃতিত্ব দাবি করতে পারে।