বিপ্লবোত্তর মিশরের রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণে মুসলিম ব্রাদারহুডের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। এমনকি বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রও এ ধরনের সরকার মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। উভয়ের মধ্যে একটা পারস্পরিক সন্দেহ বিরাজ করছিল।
মুসলিম ব্রাদারহুড নিজেদের সংস্কার সাধন না করে, তাহলে পশ্চিমারা তাদের মিশরের রাষ্ট্র ক্ষমতায় মেনে নিবে না, এটাও নিশ্চিত ছিল। সুতরাং, মুসলিম ব্রাদারহুডের উচিত তাদের কর্মকাণ্ডে তাৎক্ষণিকভাবে ইস্তফা দিয়ে আরো সময় নিয়ে পুনরায় সংগঠিত হওয়া। আর এটা হবে ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে তাদের ভিশন সম্পর্কে নতুন করে চিন্তার মধ্যদিয়ে।
সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এখন লড়াই করে মুসলিম ব্রাদারহুড কিছুই অর্জন করতে পারবে না। কারণ মিশরের সেনাবাহিনী মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিধর এবং নির্মম। অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও উচিৎ ব্রাদারহুডের নেতাদের মুক্ত করে দেয়া। যেন সংগঠনটি চরমপন্থার দিকে পা না বাড়ায়।
মিশরের ইসলামপন্থি দলগুলোর ধ্যান-ধারণা পর্যালোচনা করে বলা যায়, আরবের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিশরকে শাসন করতে হলে ব্রাদারহুডকে নিজেদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার আনতে হবে;
১. তিউনিসিয়া এবং তুরস্ক থেকে শিক্ষা গ্রহণ
মুসলিম ব্রাদারহুডকে তুরস্ক এবং তিউনিসিয়ার কাছে থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজের ‘বহুমুখিতা’ মেনে নিতে হবে। আর এটাও মেনে নিতে হবে যে, সেক্যুলার রাষ্ট্র মাত্রই ইসলাম বিরোধী নয়। প্রকৃতপক্ষে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রই মিশরের ইসলামপন্থি, কপটিক খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে।
২০১২ সালের জুনে তিউনিসিয়ার ইসলামপন্থি দল আন্না হাদার প্রধান রশীদ ঘানুসি মুসলিম ব্রাদারহুডকে পরামর্শ দেন, মুরসি যদি সেক্যুলারদের ক্ষমতার ভাগ না দেন, তাহলে তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবীরাও তাকে আর সমর্থন করবে না। তিউনিসিয়ায় ইসলামপন্থিরা সংবিধানে ইসলামি আত্মপরিচয়কে একটি মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি। কিন্তু মিশরের ইসলামপন্থিরা সংবিধানে মিশরীয়দের ইসলামি আত্মপরিচয়কে প্রতিষ্ঠার জন্য জান-প্রাণ লড়াই করে। এতে করে সেক্যুলাররা ভয় পেয়ে যায়।
তেমনিভাবে তুরস্কের এরদোগানও প্রকাশ্যেই বলাবলি করেন, ব্রাদারহুড ভুল পথে হাঁটছে। ২০১১ সালে তিনি প্রকাশ্যে মিশরের নেতাদের গণতন্ত্র মেনে নেয়ার আহবান জানান এবং বলেন, সেক্যুলারিজম মানে ‘ধর্মহীনতা’ নয়। কিন্তু এর জবাবে ব্রাদারহুডের মুখপাত্র এসাম আল আরিয়ান মন্তব্য করেন, তুরস্কের কাছ থেকে মিশরকে গণতন্ত্র শিখতে হবে না।
এরদোগান এবং ঘানুসি উভয়েই নিজ দেশের সেক্যুলার রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তারা জানতেন, ইসলামপন্থিরা তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে সেক্যুলাররাও বসে থাকবে না। এছাড়া মুরসি সমর্থকরা আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্যুলার এবং আধুনিক অ-ইসলামপন্থি মুসলিম, কপটিক খ্রিষ্টান, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম এবং বিচার বিভাগের জনমত গঠনের ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই করতে পারেনি। এছাড়া পশ্চিমারাও তাদের পুরো চার বছর ধরেই সমর্থন দিয়ে যাবে এটা ভাবাটাও ভুল ছিল। আর তারা সবচেয়ে ভয়াবহ ভুলটি করেছিল সেনাবাহিনী তাদের প্রতি অনুগত থাকবে, এটা ভেবে।
২. অভিজাতদের সঙ্গে সমঝোতা
মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা হাসানুল বান্নার সময় (১৯০৬-১৯৪৯) সংগঠনটির সফলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তিনি মিশরের অভিজাত শ্রেণী বিশেষ করে কায়রোর অভিজাত শ্রেণীর চরিত্র ভালো মতোই বুঝতেন। তিনি নিয়মিতই ন্যাশনাল অপেরা হাউজে যেতেন এবং রাজা প্রথম ফারুকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। এছাড়া তিনি গণমাধ্যম এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি আরব জগতের প্রথম ম্যাগাজিনগুলোর একটির প্রতিষ্ঠাতা। এমনকি ১৯৫২ সালের মিশরীয় বিপ্লবের নেতা মোহাম্মদ নাগিব এবং গামাল আব্দুন নাসেরও এক সময় তার অনুসারি ছিলেন।