পদত্যাগের পর মন্ত্রীদের দায়িত্ব পালন নিয়ে বিতর্ক সংবিধানের লঙ্ঘন : বিশেষজ্ঞ অভিমত

0
136
Print Friendly, PDF & Email

মন্ত্রীদের পদত্যাগের পরও দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে আইন বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। তারা বলেন, সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পরই মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের পদ শূন্য হয়ে গেছে। তাই পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পর তাদের দায়িত্ব পালন সংবিধানপরিপন্থী। পদত্যাগের পর তারা দাফতরিক কোনো কাজ করলে কিংবা সুবিধা নিয়ে থাকলে তা আইনানুযায়ী অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। সাংবিধানিক জটিলতা নিরসন না করে সুবিধা গ্রহণ করলে পরে সংশ্লিষ্টরা অভিযুক্ত হতে পারেন বলে আইন বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে পদত্যাগী আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেছেন, পদত্যাগপত্র জমা দিলেই তা কার্যকারিতা লাভ করবে না। উত্তরাধিকারীরা দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা স্বপদে বহাল থাকবেন। সংবিধানের ৫৮(১)(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছেÑ ‘প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ অর্থাৎ পদত্যাগ করা একজন মন্ত্রীর সাংবিধানিক অধিকার। আইনবিদেরা বলছেন, সংবিধানের এই বক্তব্য অনুসারে যখন একজন মন্ত্রী পদত্যাগপত্র জমা দেবেন তখনই তা কার্যকর হবে। কিন্তু পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পরও গতকাল সোমবার সচিবালয়ে অফিস করেছেন প্রায় সব মন্ত্রী। বলা হচ্ছেÑ তারা পদত্যাগপত্রে কোনো তারিখ উল্লেখ করেননি। আইনবিদেরা বলছেন, তারিখ উল্লেখ না করে তারা চতুরতার আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেছেন। সংবিধানে পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ার ব্যাপারে তারিখ উল্লেখের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তারা পদত্যাগ করে তা জনসমক্ষে এবং গণমাধ্যমের কাছে বিষয়টি প্রকাশ করেছেন। অতএব তারা যে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, এর মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। তাই পদত্যাগের পর তারা আর স্বপদে বহাল নেই। আর সংবিধানের ৫৮(১)(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ তবে ৫৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকিলে মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে; তবে এই পরিচ্ছেদের বিধানাবলী-সাপেে তাহাদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাহারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকিবেন।’ বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, সংবিধানের ৫৮(১)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য সব মন্ত্রী যে মুহূর্তে পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেবেন রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার জন্য, তাদের পদ সেই মুহূর্ত থেকে বাধ্যতামূলকভাবে শূন্য হিসেবে বিবেচিত হবে। পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পরও যদি কেউ দায়িত্বে থাকাকালীন পদের কোনো কাজ করেন তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি। একই সাথে সংবিধানপরিপন্থী। পদত্যাগপত্রে তারিখ উল্লেখ বেলে পদত্যাগীরা যেসব কথা বলছেন তার উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক এই সভাপতি আরো বলেন, পদত্যাগপত্রে তারিখ উল্লেখের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই সংবিধানে। অতএব পদত্যাগের পর তারা যদি সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা নেন তবে তা-ও হবে অবৈধ। তবে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, পদত্যাগপত্র জমা দিলেই কেউ মন্ত্রিত্ব হারাবেন না। সংবিধানে আছেÑ রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করার উদ্দেশ্যে যদি কেউ প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র জমা দেন তবে তা কার্যকারিতা লাভ করবে এবং তার পদ শূন্য হবে। কিন্তু যারা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, তারা কেউ রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করার জন্য তা দেননি। তিনি আরো বলেন, এখন পদত্যাগপত্র জমাদানকারীদের কেউ যদি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন যে, তার পদত্যাগপত্র কার্যকর করা হোক, তবে প্রধানমন্ত্রী তা রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করবেন এবং তার পদ শূন্য হবে। তিনি আরো বলেন, সংবিধানে আছেÑ প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন। এ ক্ষেত্রে ঘোষিত সর্বদলীয় সরকারের কোনো সদস্য বা অন্য কোনো উত্তরাধিকারী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত কারো পদ শূন্য হচ্ছে না এবং তিনি তার দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন। গতকাল সুপ্রিম কোর্টে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের এক সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব ও বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, যেহেতু মন্ত্রীগণ ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের উদ্দেশ্যে পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করেছেন, সেহেতু স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাদের মন্ত্রীপদ শূন্য হয়েছে বলে গণ্য হবে। সুতরাং মন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগপত্র প্রদানের সময় থেকে মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকা এবং সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করা অবৈধ। যেহেতু তারা এখন মন্ত্রী হিসেবে নেই, তাই এখন তারা কোনো নির্বাহী কাজে অংশ নিতে পারবেন না। সাবেক জেলা জজ ও বিশিষ্ট আইন বিশ্লেষক ইকতেদার আহমেদ বলেছেন, সংবিধান অনুসারে একজন মন্ত্রী পদত্যাগ করলে তাৎক্ষণিকভাবে তা কার্যকর হয় এবং তার পদ শূন্য হয়। একজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেন তার পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের উদ্দেশ্যে। পদত্যাগপত্রে তিনি তারিখ উল্লেখ করুন বা না করুন, তা যে মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরণের নিমিত্তে প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হবে সে মুহূর্ত থেকেই কার্যকর বলে বিবেচিত হবে। সে মুহূর্ত থেকেই পদত্যাগী মন্ত্রীর পদ শূন্য হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো মন্ত্রী পদত্যাগ-পরবর্তী তার কার্যালয়ে কোনো কার্য সম্পাদন করলে তা হবে অবৈধ। তিনি আরো বলেন, একটি বিষয় দেখতে হবে যে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তার মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা তাদের উত্তরাধিকারী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন। কিন্তু আমরা দেখলাম, এখানে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য সব মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। তাই সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগীদের পদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র হস্তান্তরের সাথে সাথেই শূন্য হয়ে গেছে। এখানে সংবিধান অনেক স্পষ্ট। কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই।

শেয়ার করুন