সংশোধিত আইনে দুদক এখন ঠুঁটো জগন্নাথ

0
159
Print Friendly, PDF & Email

আইন করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হল। পঙ্গু করে দেয়া হল স্বাধীন এ প্রতিষ্ঠানটিকে। দুদক এখন ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’। দুদকের নির্বাহীরা এখন এমনটিই মনে করছেন। রোববার দুদকের ক্ষমতা খর্ব করে সরকার জাতীয় সংসদে দুর্নীতি দমন কমিশন সংশোধন বিল-২০১৩ পাস করে। সংশোধিত আইন অনুযায়ী, সরকারের কোনো মন্ত্রী-এমপি বা আমলার বিরুদ্ধে, এমনকি সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে এবং মামলায় আদালতে চার্জশিট দিতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দুদককে পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এই কর্তৃপক্ষ বলতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে বোঝানো হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন বছর অপেক্ষার পর সরকার তার মেয়াদের একেবারে শেষ সময়ে এসে দুদকের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সংশোধিত আইন পাস করায় দুদক স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। দুদকের কর্মকর্তারা হতভম্ব। কি করার কথা ছিল। আর কি করা হল সে প্রশ্ন তাদের সবার।
সংশোধিত আইনের যে বিলটি সংসদে তোলা হয় তার উদ্দেশ্য ছিল- দুদককে অধিকতর শক্তিশালী ও কার্যকর করা। দুদক আইনজীবী খোরশেদ আলম খান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, সরকার বিলের উদ্দেশ্য হতাশাব্যঞ্জক করে তুলেছে। আইন করে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে দুদককে। এর প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষাও আমাদের কাছে নেই। দুদক চেয়ারম্যান এম বদিউজ্জামান দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সরকার সংসদে যে বিলটি পাস করেছে তা সংবিধানের ২৭ ধারা ও দুদক আইনের ২৪ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আইনের ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি আরও বাড়বে। তারা দুর্নীতি করার ক্ষেত্রে আরও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে।
দুদক কমিশনার (তদন্ত) এম সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বললেন, আইন করে দুদকের হাত-পা বেঁধে দেয়া হল। নতুন আইনটি সংবিধানের ২৭ ধারার পরিপন্থী। ওই ধারার বিধান মতে দেশের সব নাগরিক আইনের সমান অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু দুদকের সংশোধিত আইন অনুসারে সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের জন্য এক নিয়ম, আর সাধারণ মানুষের জন্য আরেক নিয়ম। এটা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। দুদক কর্মকর্তারা বলেন, এক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সরকার দু’ধরনের প্রাকটিস করাতে চায়। সরকারের হাতে মামলার অনুমোদন ফিরিয়ে নেয়ার ফলে কি সমস্যা হতে পারে জানতে চাইলে কর্মকর্তারা বলেন, দেখা গেল কমিশন কারও বিরুদ্ধে অনুমোদন দিল বা সুপারিশ করল, কিন্তু সরকার দিল না এমন ঘটনা ঘটতে পারে। আবার বিপরীত চিত্রও হতে পারে। এভাবে টনাহেঁচড়ায় দুদকের কাজ মারাত্মকভাবে বিঘিœত হবে। দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কাছ থেকে মামলার অনুমোদন নেয়ার ক্ষেত্রে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলের যে বিধানটি ছিল,তা ফিরিয়ে আনা হল। এতে করে সরকারই হয়তো একদিন বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। কারণ প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে মন্ত্রী-এমপিরাও রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুদক কোনো মামলা করার সুপারিশ করলে সরকার যদি তাতে অনুমোদন না দেয় তবে গণমাধ্যম তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সেই তথ্য বের করে জাতির সামনে প্রকাশ করে দিলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে।
২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের পর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা সংশোধন করে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা ও চার্জশিট দেয়ার ক্ষমতা দুদকের হাতে আনা হয়। সেই থেকে ৯ বছর ধরে দুদক সেভাবেই কাজ করে আসছিল। দুদক ভাবছিল আইনটি সংশোন করা হলে সরকার হয়তো আরও একটু ক্ষমতা দুদককে দেবে। যাতে করে সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। দুদক এখন থেকে সরকারের অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলাই করতে পারবে না।
এই বিধানের মাধ্যমে সরকার আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশও উপেক্ষা করল। কেননা, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এ বিধান না রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল। বিলটি পাসের আগ পর্যন্ত দুদকও জানত এই বিধানে কোনো ব্যত্যয় ঘটানো হবে না। কিন্তু সুপারিশে না থাকলেও বিলটি সংসদে পাস করার আগে তাতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা পুনরায় বাধ্যতামূলকভাবে সংযোজন করা হয়। সাড়ে তিন বছর পর পাস হওয়া এই বিলে নতুন করে ৩২/ক ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা আবশ্যিকভাবে পালন করতে হবে। আর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারায় বলা রয়েছে, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মকর্তা কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছিলেন, তিনি দুদককে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করবেন। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারে এ বিষয়টি ছিল। কিন্তু এরপরও কেন এমনটি করা হল তা বুঝে আসছে না। সরকার কথা রাখেনি।
মিথ্যা মামলা করা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ৫ বছরের শাস্তি বিধান এবং পুলিশকে দিয়ে দুদকের কর্মকর্তাদের অপরাধের তদন্তের বিধান আইনে যুক্ত করায় দুদকের কর্মকর্তারা হতবাক। তারা বলেছেন, সরকার যা করেছে তাতে দুদকে আর কাজ করার পরিবেশ নেই। আইনে বলা হয়েছে, কমিশন (দুদক) নিজ কর্মকর্তাদের অপরাধ তদন্ত করতে পারবে না। তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপরাধ তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থাকে দিতে হবে। সোমবার দুদকে গিয়ে দেখা গেছে, তদন্ত কর্মকর্তারা দলে দলে দুদকের তিন নির্বাহীর কক্ষে গিয়ে তাদের ক্ষোভের কথা প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, সরকার তাদের হাত-পা কেটে ঠুঁটোজগন্নাথ বানিয়ে দিয়েছে। তদন্তে গাফিলতি হলে বিভাগীয় শাস্তি হতে পারে। এর জন্য ৫ বছরের শাস্তির বিধান তারা মেনে নিতে পারছেন না। একইভাবে তাদের অপরাধের তদন্ত পুলিশকে দেয়ায় পুলিশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা এখন তদন্ত করতে গেলে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়বেন।

শেয়ার করুন