তিন দিন ধরে ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকেও দৃঢ়চিত্ত বেগম খালেদা জিয়া। তার মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বা কোনো হতাশার ছিটেফোঁটার ছাপাও নেই, একদম স্বাভাবিক। নিজ বাসভবনে রুদ্ধপ্রায় পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশাজীবী নেতাদের সাথে আলাপকালে বিএনপি চেয়ারপার্সন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছেন, নিপীড়ন, নির্যাতন ও বন্দিদশার সাথে আমি পরিচিত। এর চেয়েও চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। সরকারের আচরণেই বুঝা যায় তাদের পায়ের তলায় মাটি নেই। জনগণ ফুঁসে উঠেছে। এটা তারা বুঝতে পেরেছে। যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই আন্দোলন চালিয়ে যান। জনগণের আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয়নি, ব্যর্থ হবে না। শনিবার রাতে তার গুলশানের নিজ বাসভবনে তিনি এসব কথা বলেছেন। একই সাথে দলীয় নেতাকর্মীদের আরো কঠোর কর্মসূচী পালনের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তার সাফ কথা, জুলুম-নির্যাতন নিপীড়নে পরোয়া করি না। জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রয়োজনে আরও সিনিয়র নেতা কারাবরণ করবেন। কর্মসূচি এমনভাবে পালন করতে হবে, যাতে সরকার ‘ভীতসন্ত্রস্ত’ হয়ে পড়ে। সাক্ষাৎকারী কয়েকজন গতকাল ইনকিলাবকে এসব কথা জানান। এদিকে গতকাল দলের আইনজীবীরা বেগম জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।
সূত্র জানায়, তিনদিন ধরেই চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয় এবং নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় কার্যত: অবরুদ্ধ। বিএনপি চেয়ারপার্সনের বাসভবনের সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিলো। তবে গতকাল পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
শুক্রবার বিএনপির শীর্ষ পাঁচ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এমকে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসকে গ্রেফতারের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভিন্ন মোড় নেয়। বিরোধীদলের ৩০ নেতার বাসায় তল্লাশী এবং দেশজুড়ে গণগ্রেফতারে থমথমে হয়ে উঠে পরিস্থিতি।
শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত। দলীয় কার্যালয় কার্যত: অবরুদ্ধ। চেয়ারপার্সনের নিজ কার্যালয় ঘেরাও। তার বাসার সামনে যুদ্ধাংদেহী পুলিশি অবস্থান। সাদা ও পোশাকধারী র্যাব, ডিবি। সদ্য সংবাদ সংগ্রহে শত শত মিডিয়াকর্মী। সরকারের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য-মন্তব্যও উত্তেজনাকর। তার বাসায় নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া অন্যদের প্রবেশে মানা। পানি ও খাবার সরবরাহও বন্ধ। বেগম জিয়ার নিকটজনকেও বাসায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তার ছোটভাইয়ের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা খাবার নিয়ে এসে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ফেরত যেতে হয়েছে। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাফ জবাব ‘উপরের নির্দেশ’। সরকারের এহেন আচরণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সারাদেশের মানুষ। বাতাসে উড়ো খবর ভাসছে। এইবুঝি বিরোধী দলীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
শনিবার রাতে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশাজীবী দুই ডজন নেতা গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়ীতে রুদ্ধপ্রায় বিরোধীদলীয় নেতার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেতার নিরাপত্তার সার্থে সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিলো। (এর আগে রানা প্লাজা ধসের সময় এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা বিল্ডিং ধরে ঝাঁকুনি দিয়েছে বলেই ধসে গেছে)। দায়িত্বশীল এই মন্ত্রীর জবাবে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব রিজভী আহম্মেদ বলেছেন, আমরা মনে করি, নিরাপত্তার নামে বিরোধী দলীয় নেতাকে অবরুদ্ধ কিংবা গৃহবন্দি অথবা নেতা-কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার অপকৌশল নিয়েছে সরকার।
প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্পর্কে দলের প্রবীণ নেতাদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, ওয়ান ইলেভেনের পর বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাবন্দির পর মুক্ত হন তিনি। এর আগে ১৯৮৬-৮৭ সালে তাকে আত্মগোপনে যেতে হয়। চারদিন পর রাজধানীর গুলিস্তানে গোলাপ শাহ’র মাজার এলাকায় এক সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে প্রকাশ্যে আসেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তাকে জেলে যেতে হয়। ১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের আগে খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ ছিলেন।
১/১১-তে তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। কোমরের হাঁড় ভেঙ্গে দেয়া হয় তারেক রহমানের। দু’জনই বিদেশে চিকিৎসাধীন। তবুও অগণতান্ত্রিক সরকারকে মেনে নেননি তিনি।
শুক্রবার থেকে বাসায় অবস্থানকারী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাতকারী জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, নেত্রীকে মোটেও বিচলিত দেখায়নি বরং তিনি ডিটারমাইন্ড। বলেছেন, সরকারের পায়ের তলায় মাটি নেই বলেই সরকারবিরোধী দলীয় নেতাদের নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছে। জনগণই এর জবাব দেবে। আলাপকালে বেগম জিয়া দৃঢ়কণ্ঠেই বলেছেন, আমি এরচেয়ে আরো বেশি প্রতিকূল পরিস্থির মোকাবেলা করে এসেছি। নির্যাতন-নিপীড়ন ও বন্দিদশার সাথে তিনি পরিচিত। চলমান আন্দোলনে সফলতায় তিনি আশাবাদী। বিএফইউজে’র সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলে, এরকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাহ্যিক দিক থেকেও কোনো হতাশার ছাপ দেখা যায়নি। গণতন্ত্রকামী বেগম খালেদা জিয়া প্রবল আত্মবিশ্বাসী। আলাপকালে তিনি জানিয়েছেন সরকার যতোই ফন্দি আটুক এক দলীয় নির্বাচন করতে পারবে না। দেশের জনগণই তাদের প্রতিরোধ করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. আ ফ ম ইউসুফ হায়দার জানান, নানামুখী চাপের মধ্যেও বিরোধী দলীয় নেতাকে স্বাভাবিক ও দৃঢ়চিত্র মনে হয়েছে। তিনি যার যার অবস্থান থেকে আন্দোলনে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।
বিএনপির যুগ্মমহাসচিব রিজভী আহম্মেদ জানান, বেগম জিয়া বলেছেন, শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের গ্রেফতারের পর দলীয় নেতা-কর্মীদের আরও কঠোরভাবে কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার সাফ কথা, প্রয়োজনে আরও সিনিয়র নেতা গ্রেফতার হবে। কিন্তু কর্মসূচি এমনভাবে পালন করতে হবে, যাতে সরকার ‘ভীতসন্ত্রস্ত’ হয়ে পড়ে।
এখনো নয়াপল্টন ও গুলশান কার্যালয় অবরুদ্ধ প্রটোকলের পুলিশ ফেরত
গতকালও বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। কার্যালয়ের স্টাফরা গ্রেফতার আতঙ্কে আসেননি। কার্যালয়ের কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন নসু জানান, গতকালও কার্যালয়ের সামনে বিপুলসংখ্যক পোশাকধারী ও সাদা পোশাকের পুলিশ ছিলো। তারা কেউই কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। এদিকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালও পুলিশ অবরুদ্ধ করে রাখে। কার্যালয়ের সামনে রায়ট কার, গরমপানির গাড়ী, প্রিজন ভ্যানসহ রণাঙ্গনের প্রস্তুতি ছিলো পুলিশের। গণমাধ্যম কর্মী ছাড়া কোনো নেতাকর্মী কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারেনি। বেগম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তায় নিয়োজিত এক কর্মকর্তা জানান, বিরোধীদলীয় নেতার প্রটোকল দিতে যে পুলিশ দেয়া হয়েছিলো তা ফের মোতায়েন করা হয়েছে। র্যাব-ডিবির সদস্যদেরও প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যতই আটঘাট বেঁধে নির্বাচনের চেষ্টা করুক মানুষ তা প্রতিহত করবেই। বিএনপিকে জনবিচ্ছিন্ন করতে সরকারের নানামুখী কৌশল কোনো কাজে আসবে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার থাকার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। বরং বিএনপিই জনগণের দল হিসেবে বিজয়ীর বেশে ক্ষমতায় যাবে। শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। দেশের সিনিয়র নাগরিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ সবার অভিমত দুই দলের মধ্যে আস্থার সংকট দূর না হওয়া পর্যন্ত নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। দেশী বিদেশী বিভিন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংগঠন চায় অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের আয়োজন করা হোক। জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীনসহ প্রভাবশালী দেশ ও দাতা সংস্থাগুলো সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। এ জন্য সর্বমহল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির উপর চাপ দিচ্ছে। দেশী বিদেশী সর্বমহলের চাপে বিরোধী দলে থেকেও বিএনপি কিছু ছাড় দিয়েছে। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ থেকে সরে এসে ‘নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকারের দাবি করছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদের অবস্থানে অনড়।
রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বিরোধী দল ঘনঘন হরতাল দেয়ায় জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। সরকারের কাছে খবর আছে, বিক্ষুব্ধ জনতা খালেদা জিয়ার বাড়িতে হামলা করতে পারে। তাই তার বাসায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।”