গত ২৫ অক্টোবর রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার মহাসমাবেশের মাধ্যমে শুরু হয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮দলীয় জোটের ফাইনাল খেলা। প্রতিপক্ষে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। ইতোমধ্যে দুই নেত্রী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সর্বদলীয় সরকারের কথা আর বিরোধী দলীয় নেতা দিয়েছেন নির্দলীয় সরকারের রূপ রেখা।
মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে চূড়ান্ত খেলায় জেতার অভিপ্রায় নিয়ে হুংকার ছেড়েছেন বিরোধী দলের নেতারা। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা আওয়ামী জোটের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কা করে দলীয় নেতাকর্মীদের দেন দা-কুড়াল তত্ত্ব। কিন্তু দা-কুড়াল তত্ত্ব দিয়ে নিজেকেই আত্মগোপনে যেতে হয়। পুলিশ তাকে খুঁজতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়! শেষ পর্যন্ত অবশ্য শান্তিপূর্ণভাবেই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। খোকাও সমাবেশে যোগ দিয়ে সভাপতিত্ব করেন। কিন্তু দা-কুড়াল তত্ত্ববিরোধী জোটের জন্য কতোখানি কল্যাণ বয়ে আনলো তার পরিমাণ এখনও কেউ প্রকাশ করেন নি।
ফাইনাল খেলা শুরু হওয়ার পর নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে এরই মধ্যে ৬০+৬০= ১২০ ঘণ্টার হরতাল পালন করে বিরোধী জোট। আজ থেকে শুরু হলো তৃতীয়বারের হরতাল। এবারের মাত্রাও বেশি। গত শুক্রবার বিকেলে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে ১৮ দলীয় দলগুলোর মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে ৭২ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণা দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ দিন দুপুরে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের প্রভাবশালী সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে গণকারফিউ জারির হুমকি দেন। ওইদিনই সন্ধ্যায় হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে থেকে আটক হন মওদুদ আহমেদ। সেই সঙ্গে বিএনপির আরও দুই স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার এবং ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। জবাবে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘নাশকতা প্রতিরোধে তাদের আটক করা হয়েছে।’ মধ্যরাতে বেগম খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবন থেকে বের হওয়ার সময় আটক হন বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ব্যবসায়ী নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু। ব্যবসায়ী নেতাকে আটক করায় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কারণ দুই দলের মহাসচিব পর্যায়ে নিঃশর্ত সংলাপের জন্য ব্যবসায়ীরা যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন আব্দুল আউয়াল মিন্টু।
দলের শীর্ষ ৫ নেতা আটকের পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছেন দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতারাও রয়েছেন খেলার বাইরে। আত্মগোপনে থেকেই টেলিফোনে গণমাধ্যমের সঙ্গে কেউ কেউ কথা বলছেন।
শুক্রবার থেকেই বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসা এবং তার রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পাশাপাশি নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ছিল সতর্ক অবস্থায়। শুক্রবার রাতে বাসায় ঢোকার পর বিএনপির কোনো সিনিয়র নেতা এখনও তার সঙ্গে দেখা করেন নি। এমনকি বেগম খালেদা জিয়াও বাসা থেকে বের হননি।
সার্বিক পরিস্থিতিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ অভিযোগ করেন, অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করছে সরকার। বলতে গেলে উনি (খালেদা জিয়া) অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। স্বাধীন দেশের একজন নাগরিককে এভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা যায় কি-না বাংলাদেশের জনগণ সেটা বিবেচনা করবে।’
তবে বিএনপি চেয়ারপারসনকে অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে তথমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়ার চলাচলের ওপর সরকার থেকে কোনো বাধা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়নি।’ পাশাপাশি তিনি এও বলেন, ‘যারা সহিংসতার সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। খালেদা জিয়াও এই সহিসংতার সঙ্গে জড়িত। তাকে গ্রেপ্তার করা হবে কি-না সেটাও ভেবে দেখা হচ্ছে।’
গত দুই কিস্তির হরতালে অন্তত ২৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর দায় দুই জোট পরস্পরের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে দাতা দেশগুলোও রয়েছে উদ্বেগে। পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষের মনে বেঁধেছে আতঙ্কের দানা।
শনিবার রাতে গুলশানের বাসায় গিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিএনপিপন্থী শিক্ষক-চিকিৎসক-আইনজীবী-সাংবাদিক নেতারা দেখা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক আ ফ ম ইউসুফ হায়দারের নেতৃত্বে ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইউটিএবি) একটি প্রতিনিধি দল বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ইউসুফ হায়দার সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। খালেদা জিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময়, দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করি, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল রাখার জন্য স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, সব দলের অংশগ্রহণে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রয়োজন।’ বিএনপি চেয়ারপারসনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের কারণে আলোচনার পরিবেশ বিঘ্নিত হতে পারে।’
ডা. শহীদুর রহমানের নেতৃত্বে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে আন্দোলন চালিয়ে নেয়ার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের রাজপথে থাকার নির্দেশ দেন। এই পরিস্থিতিতে চেয়ারপারসনের নির্দেশ উপেক্ষা করে নেতারা কি আত্মগোপনে থাকবেন না-কি রাজপথে নামবেন? আর সহিংসতারোধে কী পদক্ষেপ নেবে সরকার?