এ লেখা যখন লিখছি তখন বিরোধী দলের ওপর নতুন করে দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গভীর রাতে খালেদা জিয়ার বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় গ্রেফতার হয়েছেন ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস। কী অভিযোগে তাঁদের গ্রেফতার করা হলো পুলিশ জানায় নি।
এছাড়া রাতে সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদীন ফারুক, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ঢাকা জেলা বিএনপি সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীমসহ বিএনপির অসংখ্য নেতার বাসায় গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। গ্রেফতার অভিযান শেষ হয় নি। চলছে। এই পরিস্থিতিতে খালেদা কী করবেন। তিনি আরও কঠোর কর্মসূচি দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনো পথ খোলা নাই।
এই ধরপাকড় ও দমনপীড়ন রাজনীতিকে আরও সংঘাতসংকুল করে তুলবে, এতে সন্দেহ নাই। যেসকল শ্রেণী, শক্তি বা গোষ্ঠি বাংলাদেশকে দীর্ঘকাল শাসন করছে তারা আজ অবধি একটি স্থিতিশীল নির্বাচনকেন্দ্রিক উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে পারে নি। এখন যারা ক্ষমতায় আছে তাদের ভূমিকা মুমূর্ষু ব্যবস্থাকে কফিনে পুরে দেওয়া। সেই কাজ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও হিংস্রতার যে-চেহারা আমরা দেখছি তা নতুন কিছু নয়। ক্ষমতাসীন শক্তির এখনকার চেহারা নতুন কোন অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। অশুভ শক্তিকে মোকাবিলা করবার সঠিক পথ কি হবে?
অনেকে তর্ক করতে পারেন যে ক্ষমতাসীন থাকার সময় বিএনপিও বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের দাবিদাওয়া এভাবেই দমনপীড়ন করে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই তর্কের সত্যাসত্য বিচার হতেই পারে। কিন্তু যাঁরা এই তর্ক তুলছেন তারা আসলে বলতে চান, বিএনপি যেহেতু এভাবেই ক্ষমতাসীন থাকার সময় দমনপীড়ন করেছে, অতএব মহাজোট সেই একই ভাবে এখন বিএনপিকে দমন করবে, সম্ভব হলে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে। মহাজোট মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে, এটাই এখন স্পষ্ট হচ্ছে। আওয়ামি লীগকে সংগ্রাম করেই তত্ত্বাবধায়কের দাবি আদায় করতে হয়েছে, অতএব এখন আঠারো দলীয় জোটকেও তার চেয়েও শতগুণ বেশি রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের পছন্দের নির্বাচনকালীন সরকার আদায় করে নিতে হবে। নির্বাচনসর্বস্ব উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বহাল রাখার দায় দুই পক্ষের কেউই নিতে চায় না। এর আরও সরল অর্থ হচ্ছে, রাজনীতির দুই প্রধান প্রতিপক্ষের কেউই সাংবিধানিক রাজনীতির চর্চা করে না, এবং করতেও চায় না। যদি প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাংবিধানিক, নিয়মতান্ত্রিক বা আইনী রাজনীতির চর্চা করার ক্ষেত্রে অনীহা থাকে তাহলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের নিরসন অসম্ভব।
এই সহজ সত্য চোখের সামনে হাজির থাকার পরও ঢাকার সুশীল নাগরিকদের কথাবার্তা অর্থহীন কোলাহল ছাড়া আর কোনোই অর্থ বহন করে না। যেখানে নিরপেক্ষ ভাবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচার করা দরকার সেখানে স্বল্প দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সুশীল সমাজের প্রায় সকলেরই অবস্থান ক্ষমতাসীনদের পক্ষে। তারা সকলে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে বলছেন সেকথা বলছি না, কিন্তু এখনও তারা সংলাপের কথা বলছেন, এখনও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সংকট মীমাংসার আশা করছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে যখন বিরোধী জোটের পক্ষে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নাই। যেখানে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো পরিসর নাই বললেই চলে এবং প্রথাগত উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের কিছুই কার্যত অবশিষ্ট নাই সেই ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশা ও অনুরোধ করা মূলত নির্লজ্জ ভাবে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে দাঁড়ানো। বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ন্যায্যতা দান এবং শেখ হাসিনার অন্যায় অবস্থানকে শক্তিশালী করা।
আঠারো দলীয় জোটের দিক থেকে কড়া কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নাই। দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে এখন। প্রস্তুতি হিসাবে আঠারো দলীয় জোটকে দ্রুত তাদের সংগ্রাম কমিটিগুলো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে হবে। কিছু জেলায় এই কমিটিগুলো গঠিত হয়েছে ও কাজ করছে বলে শোনা যাচ্ছে। প্রায় সবকটি গণমাধ্যম ক্ষমাতাসীন মহাজোটের পক্ষে সক্রিয়। সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের ক্ষেত্রে যে প্রকট অসাম্য রয়েছে তার গুনাহগারি ভোগ করতে হবে মহাজোটকে। ফলে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে কী হচ্ছে তার পূর্ণ চিত্র আমরা পাচ্ছি না।
আমি সবসময়ই শুধু নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির ভিত্তিতে বিরোধী দলের আন্দোলনকে সমালোচনা করেছি। উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল যখন কাজ করে সেই কাঠামোর মধ্যে এই ধরণের দাবির উপযোগিতা একান্তই নির্বাচনের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন সরকারের চরিত্র হিসাবে নিলে আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া এই দাবিও আদায় করা অসম্ভব। সেই ক্ষেত্রে এই দাবির সীমিত ও সংকীর্ণ চরিত্র গণমানুষকে আন্দোলন সংগ্রামে কতোটা আগ্রহান্বিত করবে সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীনরা পরিস্থিতিকে যেখানে ঠেলে দিয়েছে তার ফলে জনগণএখন অনেক বেশী বিক্ষুব্ধ। ক্ষমতাসীনরা তাদের ভাবমূর্তি উদ্ধারের যতোই চেষ্টা করুক, বারবার তারা তাদের হিংস্র চেহারাকেই সামনে নিয়ে আসছে। ফলে সাধারণ ভাবে বাংলাদেশে আন্দোলন-সংগ্রামের একটি পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আঠারো দলীয় জোট একে ঠিক ভাবে গুছিয়ে, জনগণের ইচ্ছা ও আকাংখাকে দাবি দাওয়া হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে একে বেগবান করতে পারবে কিনা সেটা অচিরেই আমরা দেখব।
ইতোমধ্যে আন্দোলনকে নস্যাৎ করবার জন্য অমুসলিম ধর্মালম্বীদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। পরিকল্পিত ভাবে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। এ চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। আঠারো দলীয় জোটের পক্ষ থেকে এই ক্ষেত্রে সতর্ক হুঁশিয়ারী দান করা হয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে ইসলামপন্থী দল ও বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের পক্ষ থেকে এই ধরণের অপচেষ্টার বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে। লক্ষ্য করবার বিষয়, বাংলাদেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যম আলেম-ওলেমা ও ইসলামপন্থী দলগুলোর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অবস্থানের খবর দেয় নি বললেই চলে। সাম্প্রদায়িকতার জন্য শুধু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও আলেম-ওলেমাদের দায়ী করবার প্রথাগত অভ্যাস বা ইসলাম-বিদ্বেষই একমাত্র কারণ নয়। আসলে পরিকল্পিত ভাবে বাংলাদেশে দাঙ্গা লাগাবার ক্ষেত্রে কয়েকটি গণমাধ্যম সক্রিয় ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। যার দায় তারা ইসলামপন্থি দলগুলোর ওপরই চাপাবে। বাংলা পত্রিকার ভূমিকা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও একটি প্রথম সারির ইংরাজি পত্রিকার ভূমিকা এই ক্ষেত্রে ভয়ানক বিপজ্জনক। এই পত্রিকাটিই মূলত ঢাকার কূটনৈতিক চিন্তাকে প্রভাবিত করে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশের প্রতি পাশ্চাত্য দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী নির্ণয়ে নির্ধারক ভূমিকা রাখে। ইসলামপন্থী ‘মৌলবাদী’রাই সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করছে এটা প্রমাণ তারা আন্তর্জাতিক মহলে নিরন্তর প্রচার করে যাচ্ছে।
বিরোধী দলীয় কর্মসূচিতে জনগণের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বাড়াতে হলে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার দাবি ছাড়াও আঠারো দলীয় জোটকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে অবস্থান ব্যক্ত করতে হবে। স্থানীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করবার পথ হচ্ছে এ স্থানীয় ইস্যুগুলোও সরকার পতনের দাবির পাশাপাশি উত্থাপন করা এবং গণসমর্থনের ভিত্তি দ্রুত তৈরি করা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতির প্রশমন খুব সহজে হবে না।
সম্ভবত আঠারো দলীয় জোটও বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন ভিন্ন ভাবে করছে না। অর্থাৎ কঠোর অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প শেখ হাসিনা রাখেন নি। এটা তাদের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু তিনি আদৌ কখনও রাখতে চেয়েছেন কিনা সেটাও একটি প্রশ্ন। এই ক্ষেত্রে আমার সবসময়ই মনে হয়েছে শেখ হাসিনা কখনই সংলাপ হোক এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান বের হয়ে আসুক সেটা কখনই চান নি। যে কারনে পরিস্থিতি আজ এখানে এসে ঠেকেছে।
আঠারো দল তাদের এ যাবতকালের আন্দোলন ও কর্মসূচির ফলাফল কিভাবে মূল্যায়ন করে তার ওপর তাদের পরবর্তী কর্মসূচির সাফল্য নির্ভর করবে। গণমাধ্যমের ভূমিকাও কর্মসূচির সাফল্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। কিন্তু গণমাধ্যমের বড় অংশই সরকার পক্ষীয়। তাদের খবর ও বিশ্লেষণ খুবই একদেশদর্শী। সরকার-বিরোধী সংবাদপত্র ও টেলিভিশন অবৈধ ভাবে বন্ধ করে রাখায় সংবাদ প্রচারে ও ব্যাখ্যায় যে অসাম্য সৃষ্টি হয়েছে বলাবাহুল্য তা আঠারো দলীয় জোটের বিপক্ষেই যাবে। বিশেষত বিরোধী দলের কঠোর কর্মসূচিতে কিভাবে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে ও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই প্রচার চলবে। সেটা চলছেও সারাক্ষণ। ক্ষমতাসীনরা যথারীতি এর দায় আঠারো দলীয় জোটের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। যদিও তা বিশ্বাস করানো কঠিন, কিন্তু এই অপবাদের প্রচারমূল্য কম না। যদি অঘটনের গোড়ার দিকে তাকাই তাহলে বলতেই হয় বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পঞ্চদশ সংশোধনী প্রধানত দায়ী। ক্ষমতাসীনরা একতরফা তাদের সুবিধা মতো সংবিধান বদলিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে। বিরোধী দল তাদের স্বার্থহানি হয় বলে সেটা মানছে না। মানবার কোন যুক্তি নাই।