সারাদেশের বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। রাজপথেই সমস্যার সমাধান করতে প্রস্তুত তারা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ইতিমধ্যে আমরা দুই দফায় হরতাল করেছি। কিন্তু সরকার তাতে কোনো সাড়া দেয়নি। সেজন্য বাধ্য হয়ে আমরা আবার কঠোর কর্মসূচি দিয়েছি। আগামীকাল রোববার ভোর ৬টা থেকে শুরু হয়ে আগামী বুধবার ভোর ৬টা পর্যন্ত এই হরতাল হবে। গতকাল শুক্রবার বিকালে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর তিনি কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ১৮ দলীয় জোট এ নিয়ে তিন দফা হরতাল আহবান করলো। ৭২ ঘন্টা হরতাল কর্মসূচি ঘোষণার আগে তারা গত ২৭-২৯ অক্টোবর এবং ৪-৬ নভেম্বর দুই দফায় ১২০ ঘন্টা হরতাল করেছে। এদিকে বিএনপি ও জোট সূত্র জানিয়েছে, ৭২ ঘণ্টার হরতালে বাধা বা অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা ঘটলে হরতাল আরো বাড়তে পারে।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ বলেছেন, সরকার যদি সমঝোতার পথে না আসে আন্দোলনের কর্মসূচি তীব্রতর করা হবে। ১৯৯৪-৯৫ সালে আওয়ামী লীগ যেসব কর্মসূচি দিয়েছিলেন, তা আমরা ভুলে যাইনি। কেবল লাগাতার হরতাল কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। হরতাল লাগাতার করাসহ অসহযোগ, অবরোধ, অবস্থান এবং গণকার্ফিউ ঘোষণা করা হবে। ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বলেন, রাজপথই একমাত্র সমাধানের ক্ষেত্র। এ পথ ছেড়ে দিলে আজীবন হিন্দুস্থানের গোলামীর জিঞ্জিরে বন্দি হতে হবে।
আলাপকালে দলীয় নেতৃবৃন্দ ইনকিলাবকে বলেন, ’৫২ ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর স্বাধীনতা কোনটিই আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা হয়নি। সংলাপ নামের ইয়াহিয়া-মুজিবের বৈঠক এবং আবদুল জলিল ও মান্নান ভূইয়ার বৈঠকও সফল হয়নি। চলমান সঙ্কট নিরসনেও সংলাপ হবে না বলে মনে করছে বিরোধীদল বিএনপি। উল্টো দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের সকল আয়োজন ঠিকঠাক। সরকারের এহেন একগুঁয়েমি ও গোয়াতুর্মির বিরুদ্ধে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের হাটবাজার থেকে শুরু করে সারাদেশে দলনিরপেক্ষ সাধারণ মানুষও জেগে উঠেছে। তারা মতে, পেছনে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই আন্দোলনের মাধ্যমে রাজপথেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। এজন্য যে ধরনের কর্মসূচীর প্রয়োজন তার ঘোষণা দিতে বিএনপির হাইকমা-ের কাছে দাবি জানিয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গতকাল বলেন, আমরা আলোচনার অপেক্ষায়; কিন্তু পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে সমস্যার সমাধান রাজপথেই। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতনের ঘণ্টা বাজাতে হবে।
মধ্য নভেম্বরকে দেশের জন্য ‘ক্রান্তিকাল’ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। এ সময়ের পর দেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটবে- এমন কথা এখন আলোচিত হচ্ছে বেশি। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে আবারে ছেদ পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই রাজনীতিক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের স্পষ্ট কথা নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাব না। সরকার যদি আমাদের দাবিকে অগ্রাহ্য করে তাহলে আন্দোলন আরো তীব্র হবে। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে হঠাৎ ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজন নেতা সতর্ক অবস্থানে আন্দোলন করার নির্দেশ দিয়েছেন খালেদা জিয়া। দলের যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ ওই সব নেতাদের টেলিফোন করে এমন বার্তা দিয়েছে বলে কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন। তবে কেন এ ধরনের বার্তা এসেছে, কেউ বলতে পারেননি।
মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠক : গুলশানে চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে বিকাল চারটায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে জোটের মহাসচিবদের বৈঠক বসে। আধা ঘন্টা বৈঠকের পরপরই সংবাদ সম্মেলনে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। মির্জা ফখরুল অভিযোগ করে বলেন, সরকার সমঝোতা চায় না বলে তথাকথিত সর্বদলীয় সরকার গঠনের নামে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। সরকার মুখে সমঝোতার কথা বললেও সংলাপে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। আমরা তাদের বলব, এখনো সময় আছে- সমঝোতা পথে আসুন। হরতাল কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে এর দায়-দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে।
বিএনপির এই মুখপাত্র জানান, সরকার রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ-মানববন্ধন করার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। ফলে কঠোর কর্মসূচি দেয়া ছাড়া কোনো তাদের গত্যন্তর নেই।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া দেশে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান তিনি। জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় নিষিদ্ধ হয়েছে- নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয়নি। এর নিবন্ধন বাতিল করেছে আদালত। এর বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করবে তারা। তবে এ বিষয়টি এখানে জবাব দেয়ার বিষয় নয়।
বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী কর্ম পরিষদের সদস্য ডা. রেদোয়ান উল্লাহ শাহেদী, মহাসচিবদের মধ্যে এলডিপি’র ড. রেদোয়ান আহমেদ, খেলাফত মজলিশের অধ্যাপক আহমেদ আব্দুুল কাদের, জাগপা’র খন্দকার লুৎফর রহমান, এনডিপি’র আলমগীর মজুমদার, এনপিপি’র ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, ইসলামিক পার্টির আব্দুর রশীদ প্রধান, কল্যাণ পার্টির আব্দুুল মালেক চৌধুরী, পিপলস লীগের সৈয়দ মাহবুব হোসেন, ন্যাপ’র গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া, লেবার পার্টির হামদুল্লাহ আল মেহেদি, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবদের মধ্যে জমিয়তে উলামা ইসলামের মাওলানা শাহিনুর পাশা চৌধুরী, ন্যাপ ভাসানীর হাসরাত খান ভাসানী, মুসলিম লীগের শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিদের মধ্যে ইসলাম ঐক্যজোটের মুফতি মুহাম্মদ তৈয়ব, ডিএল’র খোকন চন্দ্র দাশ ও বিজেপি’র সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সালাহউদ্দিন মতিন উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সহদপ্তর সম্পাদক আব্দুুল লতিফ জনি ও শামীমুর রহমান শামীমও বৈঠকে ছিলেন।