আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরের বেপরোয়া দুর্নীতি ও অকল্পনীয় দুঃশাসন চাপা পড়ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে। বিরোধী দল একমাত্র এই ইস্যুতেই সর্বশক্তি নিয়োগ করায় এবং সব আলোচনা এই ইস্যুকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলটির দুঃশাসনের নানা দিক থেকে যাচ্ছে আলোচনার বাইরে।
অথচ নির্বাচনের আগে এসবই থাকার কথা ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে আওয়ামী লীগের চাণক্যনীতির সুবাধে দলটির পাঁচ বছরের শাসনকালের পাহাড়সমান ব্যর্থতা, বিশ্বকাঁপানো দুর্নীতির কেলেঙ্কারি আর দানবীয় শাসনসহ নানা ইস্যু এখন আর আলোচনায় আসছে না।
আগামী ২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সে হিসেবে নির্বাচনের এখন বাকি আছে আড়াই মাসের কিছুটা বেশি সময়। এখন দেশে পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার কথা ছিল। আর এই সময়টাতে স্বভাবতই চায়ের কাপে ঝড় তুলত বিদায়ী সরকারের পাঁচ বছরের আমলনামা।
বিরোধী দলের বক্তৃতা-বিবৃতি, নির্বাচনী প্রচারণা, টিভি চ্যানেলের টক শো আর সংবাদপত্রের বড় অংশ জুড়ে স্থান পেত বিদায়ী সরকারের শাসনকালের নানা দিক। বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে তো বটেই, এমনকি বাংলাদেশেও গত চারটি সংসদ নির্বাচনে এই চিত্রই দেখা গেছে। ব্যতিক্রম শুধু এবারকার নির্বাচন।
এখন লোকজনের মুখে আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরের দুঃশাসনের কথা শোনা যায় না। অথচ আওয়ামী লীগের এবারকার শাসনকাল অনেক ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের নিকৃষ্ট শাসনকালকেও হার মানিয়েছে। এবার শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে এমনসব ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে, এদেশের ইতিহাসে যার নজির নেই। অকল্পনীয় বর্বর শাসন উপহার দিয়েছেন শেখ হাসিনা। অথচ এখন এসব নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই।
সব আলোচনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনিশ্চয়তা নিয়ে। এখন সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে কিনা, তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপ ঘটবে কিনা, জনগণ প্রত্যাখ্যান করলেও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সত্যিই পরাজিত হবে কিনা এবং পরাজিত হলেও তা মেনে নেবে কিনা ইত্যাদি।
অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলছেন, আগামীতে যাতে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে রাজপথে নামতে না হয়, সেজন্য পোড় খাওয়া এই দলটি শেষ পর্যন্ত ৯০ ভাগ মানুষের প্রাণের দাবিটি মেনে নেবে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টির মাধ্যমে দলটি বহুবিধ সুবিধা পাচ্ছে।
প্রথমত, নির্বাচনী প্রস্তুতির পরিবর্তে বিরোধী দলগুলো এখন পুরো শক্তি ব্যয় করছে আন্দোলনে। অনড় অবস্থানে থেকে আওয়ামী লীগ নির্দলীয় সরকার ইস্যুতে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নিতে পারবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে দলটি বহুলাংশে সফল হয়েছে।
শেখ হাসিনার দানবীয় শাসনের খণ্ডচিত্র
প্রতিশ্রুতির বিশাল বহর দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির কথা তারা কানেই নেয়নি, অনেক ক্ষেত্রে অস্বীকারও করেছে।
শেখ হাসিনা সরকার অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে এবং মিথ্যাচার করে জনগণকে হতাশই শুধু করেনি, অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দিয়েছে। পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এসে তারা শুধু নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে।
পাঁচ বছরে বিরোধী দল ও বিরোধী মতের দমন, দুষ্টের লালন, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, দখল, হামলা-মামলা, দলীয়করণ, মিডিয়া দলনের নতুন নজির সৃষ্টি হয়েছে।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। জিনিসপত্রের দাম কমানোর অঙ্গীকার থাকলেও লাগামহীনভাবে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। দশ টাকা কেজি চাল, বিনামূল্যে সার, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি স্বপ্নই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে পেঁয়াজের কেজি হয়েছে ১২৫ টাকা।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের এই আমলে গুমের ঘটনা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক হিসেবে দেখা দেয়। বিএনপির সম্ভাবনাময় নেতা ইলিয়াস আলীর গুম ও শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের গুপ্তহত্যাও ছিল এ সরকারের একটি ভয়ঙ্কর অপকর্ম। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, এ সময় দেড় শতাধিক ব্যক্তি গুম হয়েছেন। রিমান্ডের নামে আওয়ামী বর্বরতা আইয়ামে জাহিলিয়াতকেও হার মানিয়েছে।
নরসিংদীর আওয়ামীপন্থী মেয়র লোকমান হোসেন এবং নাটোরের বড়াইগ্রামের বিএনপিপন্থী উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।
দুর্নীতি ও লুটপাট এমন পর্যায়ে গেছে যে, সেটা এখন আর দেশের মানুষ এবং বিরোধী দলই শুধু বলছে না, দাতা দেশ এবং বিদেশি সংস্থাগুলোও জোরালোভাবে বলছে।
দুর্নীতির জন্য পদ্মা সেতু ডুবেছে। উপরন্তু আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের কপালে জুটেছে দুর্নীতির কলঙ্ক তিলক। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি এখন উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে বিশ্বদরবারে। দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থায়ন বাতিল করে দিয়েছে।
দুর্নীতির জন্য সৈয়দ আবুল হোসেন মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। তিনি ২০১১ সালে এবং ২০১২ সালে দু-দুবার দুর্নীতির জন্য গণমাধ্যমে আলোচিত চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ঘটনাটি প্রমাণ হওয়ায় বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা বাতিল করে দেয়।
মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারি ও রেলের কালো বিড়ালের ঘটনা শেখ হাসিনা সরকারের আরেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এপিএস ও রেলের জিএম রাতের আঁধারে বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে মন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়ার পথে পিলখানা গেটে এই ঘুষ কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে।
পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতায় এ সরকারের আমলেও শেয়ারবাজার লুটপাট করা হয়েছে। এ সরকারের আমলে ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করেছে আওয়ামী লীগ নেতারা।
সরকারি দলের ক্যাডার, বিশেষ করে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য শিক্ষাঙ্গনের গণ্ডি পেরিয়ে দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে। ছাত্রলীগ ফ্রাংকেনস্টাইনের দানব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সিলেটের এমসি কলেজের প্রাচীন ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দিয়ে ধিক্কার কুড়িয়েছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের চাপাতি-রডে বিশ্বজিতের নৃশংস খুন ছিল চাঞ্চল্যকর ঘটনা। বিশ্বজিেক নৃশংসভাবে খুন করে দানবের উপাধি পেয়েছে সংগঠনটি। ‘আমি হিন্দু হিন্দু’ বলেও ছাত্রলীগের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি বিশ্বজিত্। এই ছাত্রলীগই শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করার জন্য দেশবাসীর ধিক্কার পেয়েছিল।
একইভাবে চলেছে যুবলীগের তাণ্ডব।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার এবার ভারতের পদতলে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে । ভারতকে ট্রানজিট প্রদান, তিতাস নদীতে বাঁধ, টিপাইমুখে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বাঁধ, তিস্তার পানি চুক্তি না হওয়া, রামপালে ভারতের স্বার্থে বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন, স্থলসীমানা চুক্তি নিয়ে ছলচাতুরী, সীমান্তে হত্যা ও কিশোরী ফেলানীর খুনির প্রহসনের বিচার মানুষকে স্তম্ভিত করেছে।
পাঁচ বছরে প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢালাও বিদেশ সফরে রাষ্ট্রীয় টাকার অপচয় অতীতের সব আমলকে ছাড়িয়ে গেছে। এসব সফরের অনেকগুলোই প্রমোদভ্রমণ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, দেশের জন্য অর্জন হয়নি কিছুই। এ সরকারের আমলে সমুদ্র জয়ের নামে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে।
সাংবাদিক নির্যাতন, হত্যা ও মিডিয়া দলনের ক্ষেত্রেও সরকার নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। পাঁচ বছরে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাসহ ১৯ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দুই হাজার সাংবাদিক।
এ সময় জনপ্রিয় চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমার দেশ দু’দফায় বন্ধ করা হয়েছে। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে প্রথম দফায় দশ মাসেরও বেশি সময় কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। দ্বিতীয় দফায় তাকে বিনাবিচারে জেলে রাখা হয়েছে এবং ১৬ দিনের রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়েছে। একজন পত্রিকা সম্পাদককে এভাবে নির্যাতন করার নজির কোনো সভ্য জগতে নেই।
সরকার দিগন্ত টেলিভিশন এবং ইসলামিক টেলিভিশনও বন্ধ করে শত শত সাংবাদিককে বেকার করে দিয়েছে। হুমকি এসেছে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোর ওপর। আক্রমণের শিকার হয়েছেন টক শোতে আসা বিশিষ্ট নাগরিকরা।
সব ক্ষেত্রেই মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। বিরোধী দলকে মিছিল-মিটিং করতে দেয়া হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর অফিস পর্যন্ত পুলিশ দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
এ সরকারের আমলে অপরাধের কোনো বিচার হয়নি। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেছে। ছেড়ে দেয়া হয়েছে ফাঁসির আসামিদেরও। অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মী দিয়ে জেলখানা ভরে ফেলা হয়েছে।
সরকারি দলের নেতাকর্মীদের প্রায় আট হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে ওইসব মামলা থেকে ক্ষমতাসীন দলের প্রায় এক লাখেরও বেশি আসামি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। বিপরীতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার এবারের শাসনমালে বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তীব্র সমালোচিত হয়েছেন। এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের পরিবর্তে একে নিয়ে রাজনীতি করতেই ব্যস্ত ছিল সরকারি দল।
সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চার দশকের স্মৃতিবিজড়িত সেনানিবাসের মইনুল রোডের বাড়ি থেকে এক কাপড়ে উচ্ছেদ করে প্রতিহিংসার নিকৃষ্ট নজির স্থাপন করেছে।
এবার বিচারবিভাগকে চরমভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে। প্রশাসনকে দলীয়করণ করে লণ্ডভণ্ড করে দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক মতলবে ঢাকাকে দুই ভাগ করা হয়েছে। অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে দেশের ৬১টি জেলায় প্রশাসক হিসেবে সরকারদলীয় নেতাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে দেশের একমাত্র নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণ এবং পরে তার বিরুদ্ধে কুত্সা রটনা ও মামলার হুমকি দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করেছে হাসিনা সরকার।
আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ এবং এর বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ ছিল এ সরকারের আমলে একটি স্মরণীয় ঘটনা।
এ সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারকে তাদের একটি সাফল্য বলে প্রচার করে। কিন্তু এই বিচারকে তারা যে একটি প্রহসনে পরিণত করে, তা প্রকাশ হয়ে পড়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কেলেঙ্কারির ঘটনায়। এই কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দেয় দৈনিক আমার দেশ ও লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্ট। এই কেলেঙ্কারির মাধ্যমে প্রমাণ হয় সরকার বিচার বিভাগকে প্রহসনে পরিণত করেছে এবং যোগসাজশের মাধ্যমে বিচার করছে। এ ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট বিচারক পদত্যাগ করেন।
বিচারপতির এই স্কাইপ কেলেঙ্কারি ছিল গত বছরের সাড়াজাগানো ঘটনা। এটা শেখ হাসিনা সরকারই ঘটিয়ে গোটা বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে গেলে সরকারের নির্দেশে চলে নির্বিচারে গুলি; চলে গণহত্যা। পুলিশের গুলিতে এবং শাসকদলের ক্যাডারদের আক্রমণে ৭ মার্চ পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীসহ ২৩১ জনকে হত্যা করা হয়। এ সময় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও মারা যান।
সর্বোপরি দল হিসেবে জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন এবং নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া চালানো হয়। জামায়াতের ৪৩ হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৫ লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে। অনেককে রিমান্ডে নিয়ে পঙ্গু করা হয়েছে। গুম করা হয়েছে আটজনকে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের সব অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের ২৪৬ নেতাকর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। দলটির নিবন্ধনও হাইকোর্ট থেকে বাতিল করা হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের প্রায় চার হাজার কোটি টাকার হলমার্ক কেলেঙ্কারি এবং ডেসটিনির প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনাটিও এ সরকারের ক্ষমতাশালী লোকজনের যোগসাজশে ঘটেছে। এ সরকারের জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার রেকর্ড হয়েছে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দু’বার গ্রেফতার, সম্মানিত ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও এবিএম মূসাকে শেখ হাসিনার অপমান করা প্রভৃতি নানা অপকর্ম ঘটেছে।
একইভাবে সরকার এ বছর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম পুলিশি অ্যাকশন চালায় এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৪৫ নেতাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। বিএনপিরও ৩০ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হয়েছে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগে তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চের নামে চলে ইসলামবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড। এ সময় আলেম-ওলামাদের নাজেহাল করা হয়। এর প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন প্রখ্যাত আলেমে দীন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। তার নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম দেশব্যাপী তৌহিদি জনতার মহাজাগরণ সৃষ্টি করে।
শাহবাগিদের অশ্লীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ এবং ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের পবিত্র কোরআন ও নবী করিম (সা.)-এর বিরুদ্ধে কুত্সা প্রচারের প্রতিবাদে হেফাজত একের পর এক প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ আহ্বান করে।
সর্বশেষ তারা ঢাকার পাঁচটি প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচির পর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নিলে ৫ মে রাতের আঁধারে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালায় সরকার। ঘুমন্ত এবং নামাজ ও দোয়া-দরুদরত অবস্থায় মুসল্লিদের ওপর এ হামলায় সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। সরকারের নির্দেশে র্যাব-পুলিশ, বিজিবি ও শাসকদলের ক্যাডারদের ওই অ্যাকশনের প্রতিবেদন প্রচারের অভিযোগে সে রাতেই সরকার দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়।
এর আগে বিচারপতির স্কাইপ কেলেঙ্কারি প্রকাশ এবং শাহবাগিদের ফ্যাসিবাদী ও ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ায় শেখ হাসিনা সরকার আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। প্রথমে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে তাকে পত্রিকা অফিসে চার মাসের বেশি সময় অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে পত্রিকা অফিস থেকে কমান্ডো স্টাইলে তাকে গ্রেফতার করে ১৬ দিনের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে। তিনি বিনা বিচারে কারারুদ্ধ রয়েছেন। সরকার জনপ্রিয় আমার দেশ পত্রিকাটিও দ্বিতীয় দফায় বন্ধ করে দেয়, যা এখনও বন্ধ রয়েছে।
তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে ১২৫ শ্রমিক আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়ার ঘটনাও এ সরকারের গাফিলতির এক ভয়াবহ নজির। এই শোক কাটতে না কাটতেই সাভারের রানা প্লাজা নামে গার্মেন্ট ভবন ধসে এক হাজার ১৩১ গরিব শ্রমিকের মৃত্যু ছিল শেখ হাসিনা সরকারের খামখেয়ালিপনা এবং উদাসীনতার এক নিষ্ঠুর নজির। তেমনি ধসেপড়া ভবন থেকে ১৭ দিন পর ‘রেশমা’ উদ্ধারের ঘটনাটিও সাজানো বলে পরে জানা যায়। এ দুটি গার্মেন্টের মালিকই আওয়ামীপন্থী।
৫ মে’র মতিঝিল শাপলা চত্বরে অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে তথ্য প্রকাশের অভিযোগে সরকার মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়।
এ সময় প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বেদনাদায়ক মন্তব্য করা হচ্ছে। টাইম সাময়িকী শেখ হাসিনার শাসনকে ‘নিকৃষ্ট শাসন’ হিসেবে মন্তব্য করেছে। দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে, ‘শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিপজ্জনক পথে নিয়ে গেছেন।’
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেশকে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার।
আওয়ামী লীগের বিবেকবান নেতাকর্মীরাও সরকারের এই বাকশালী পদক্ষেপের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তবুও শেখ হাসিনা অনমনীয়। তিনি দম্ভোক্তি করছেন—তত্ত্বাবধায়ক নয়, তার অধীনেই নির্বাচন হবে; এক চুল পরিমাণও তিনি নড়বেন না। অথচ দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ দ্ব্যর্থহীনভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষেই রায় দিয়েছে।
তবে নির্মমভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার মাশুল এখন গুনছেন শেখ হাসিনা। সরকারের জনপ্রিয়তা এখন শূন্যের কোঠায়। সম্প্রতি দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার পত্রিকার জনমত জরিপেই দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের জনসমর্থন এখন তলানিতে ঠেকেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এককভাবে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পাবে।